বাসস
  ০৭ মে ২০২৫, ১৯:২৬

১৪৬৮ কোটি টাকা আদায়ে এস আলমের ট্রেডিং পার্টনার আনসারুলের সম্পদ বিক্রির উদ্যোগ ইসলামী ব্যাংকের 

কাশেম মাহমুদ

ঢাকা, ৭ মে, ২০২৫ (বাসস) : দেশের আলোচিত ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের ট্রেডিং পার্টনার হিসেবে বহুল পরিচিত আনসারুল আলম চৌধুরী ও জিয়াউল কবির চৌধুরীকে খুঁজে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ১ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণ আদায়ের জন্য বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে তুলেছে ইসলামী ব্যাংক চট্টগ্রামের চাক্তাই শাখা।

আনসারুল এবং জিয়াউল তাদের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান টাকা ইনহেরেন্ট ট্রেডিং এন্ড ইমপেক্স লিমিটেড, ২৮০/৩ আছদগঞ্জ ঠিকানা ব্যবহার করে ব্যবসায় বিনিয়োগ এবং কারখানা প্রতিষ্ঠার নামে ২০২১ সালে ইসলামী ব্যাংক পিএলসি লিমিটেড চট্টগ্রামের চাক্তাই শাখা থেকে ১ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। যা বর্তমানে এপ্রিল পর্যন্ত প্রযোজ্য লভ্যাংশ সহ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৬৭ কোটি ৩৮ লাখ ৭১ হাজার ৪০ টাকা। 

চট্টগ্রামের চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ কেন্দ্রিক বাণিজ্য পাড়ায় চাউর আছে ইনহেরেন্ট ট্রেডিং এন্ড ইমপেক্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চেয়ারম্যান আনসারুল আলম চৌধুরী দেশের আলোচিত ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদের ফুপাতো ভাই। জিয়াউল আলম চৌধুরী ইনহেরিটেন্ট ট্রেডিং এন্ড ইমপেক্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান। 

মাসুদের গ্রামের বাড়ী পটিয়ায় এবং আনসারুল আলম চৌধুরীর গ্রামের বাড়ী রাউজানে হলেও তারা পরস্পর পারিবারিক সম্পর্কে আত্মীয়। সাইফুল আলম মাসুদ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দেশের বাইরে অবস্থান করলেও আনসারুল আলম অর্থ পাচার আইনে দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেফতার এড়াতে পলাতক রয়েছে। 

ঋণ আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল দেশের প্রচলিত নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী তেল, চিনিসহ অন্যান্য পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে কর্ণফুলি নদীর দক্ষিণ তীরে ইছানগরে কারখানা নির্মাণ ও মেশিনারিজ আমদানির জন্য এই ঋণ প্রয়োজন। তারা এর স্বপক্ষে তথ্য প্রমাণ ব্যাংকের কাছে উপস্থাপন করতে গিয়ে এস আলম গ্রুপের উৎপাদিত তেল, চিনিসহ অন্যান্য পণ্য সামগ্রী বাজারজাত করণের ট্রেডিং স্লিপ উপস্থাপন করেছে। 

ঋণ গ্রহণের সময় ইসলামী ব্যাংক চাক্তাই শাখায় কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বাসসকে জানান, ইসলামী ব্যাংক এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদের নিয়ন্ত্রণে যাবার পর তাদের (মাসুদ) কথামতো ঋণের কাগজপত্র তৈরী করে প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখানেই বোর্ড সভায় অনুমোদন দেয়া হয়েছে। 

তিনি জানান, ঋণ দেয়ার সময় এস আলম গ্রুপের সাথে ট্রেডিং পার্টনার হিসাবে তেল চিনিসহ এস আলম গ্রুপের উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী বাজারজাত করার কাগজপত্র জমা দেয়া হয়েছে। ঋণ অনুমোদনের জন্য ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পক্ষে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ব্রাঞ্চের সুপারিশ প্রেরণের টেলিফোন নির্দেশনাও এসেছে। ফলে এই ঋণের ক্ষেত্রে সাইফুল আলম মাসুদ ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রবল আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। 

তিনি জানান, উক্ত ঋণের ক্ষেত্রে যেসব সম্পদ বন্ধক রাখা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকার তেজতুরি বাজার মৌজায়  ৫১ টি প্লট, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোলেশনের আওতাধীন উত্তরা এলাকায় ১০টি প্লট, চট্টগ্রামের কর্ণফুুলি মৌজার ইছানগরে প্রকল্প এলাকায় ১২০৪ ডিসিমাল জমি (১২দশমিক ০৪ একর), চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গিবাজার এলঅকায় ৯৪ দশমিক ৪৪ ডিসিমাল(০ দশমিক ৯৪৪৪ একর) জমি। ইসলামী ব্যাংক এসব জমি ও প্লট নিলামে তুলে টাকা আদায়ের জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। তবে ব্যাংক সুত্র জানিয়েছে এসব বন্ধকি সম্পদ বিক্রয় করে ৬ থেকে ৭শ কোটি টাকা আদায় হতে পারে।

ইসলামী ব্যাংকের এসিসটেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ব্রাঞ্চ প্রধান জাকির হোসেন বাসসকে জানিয়েছেন, তিনি কিছুদিন আগে ঢাকা থেকে এই ব্রাঞ্চে যোগদান করেছেন। তবে তিনি উল্লেখ করেন, আনসারুল এর অনাদায়ী ঋণ আদায়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ইছানগরে নির্মাণ করা কারখানায় কিছু মেশিনারিজ রয়েছে। কারখানা কর্তৃপক্ষ ব্যাংককে জানিয়েছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ না পাওয়ায় তারা কারখানা চালু করতে পারছেনা। আগামী ২২ মে দরপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন। ঐদিন বোঝা যাবে আমরা কতটুকু নিলাম দর পাচ্ছি। এক্ষেত্রে যদি আশানুরূপ দর পাওয়া না যায় তাহলে কর্তৃপক্ষ পরবর্তী করণীয় বিবেচনা করবে। গ্রাহকের অন্যান্য স্থানে আর কোন সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেলে তা আদালতের মাধ্যমে ক্রোক করে ব্যাংকের পাওনা আদায় হতে পারে। ব্যাংক ১৩৩০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। যা লভ্যাংশসহ এখন ১৪৬৮ কোটি টাকায় দাড়িঁয়েছে। 

আসরারুলে বিরুদ্ধে শুধু অর্থ পাচার আইনে মামলাই নয়, তার বিরুদ্ধে রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে আরো শত কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার অভিযোগ। এসব অভিযোগের পাশাপাশি করোনাকালীন সময়ে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে ইনহেরেন্টকে ১৭০ কোটি টাকার করোনাকালীন প্রণোদনাও দিয়েছে শাখাটি। 

চাক্তাই খাতুনগঞ্জের বাণিজ্য পাড়ায় প্রচার রয়েছে দীর্ঘকাল ধরে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ তার অনুগতরা নামে-বেনামে ব্যাংক ঋণ নিয়েছে, তাদের একজন আনসারুল আলম। এস আলম গ্রুপ ঋণ নেওয়ার প্রয়োজনে যাদের ব্যবহার করত, তাদের মধ্যে কারও কারও নামে জমি-বাড়িও কিনত। পরে সেসব বাড়ি ও জমি ব্যাংকে বন্ধক রেখে বিপুল পরিমাণ ঋণের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হতো। ইসলামী ব্যাংক ছাড়াও আনসারুলের নামে ৩৪০ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে জনতা ব্যাংকে। ২০২২ সালে ব্যাংকটির আগ্রাবাদ করপোরেট শাখা থেকে এই ঋণ নেন আনসারুল। এস আলমের মালিকানাধীন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংকের ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকার এফডিআর দেখিয়ে আনসারুল ট্রেডিংয়ের নামে এই ঋণ নেয়। 

ব্যাংকগুলোর তথ্য বলছে, ২০২২ সালের ৩ নভেম্বর ঢেউটিন আমদানিকারক পরিচয়ে আনসারুল জনতা ব্যাংকে একটি হিসাব চালু করেন। এই হিসাব চালুর তিন দিনের মধ্যেই এস আলমের মালিকানাধীন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংকের কয়েকটি শাখায় কয়েকশ কোটি টাকার এফডিআর খোলা হয় আনসারুল আলমের প্রতিষ্ঠানের নামে। আর এফডিআর খোলার ১০ দিনের মাথায় ১৭ নভেম্বর জনতা ব্যাংক থেকে এক বছর মেয়াদি ৩৪০ কোটি টাকা ঋণ আবেদন করেন আনসারুল। এর বিপরীতে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকে খোলা এফডিআরগুলো জমা দেওয়া হয়। আবেদনের পরের সপ্তাহে ঋণ অনুমোদন পান আনসারুল।