বাসস
  ০৬ মে ২০২৫, ২০:১৬

ফ্যাসিবাদী প্রবণতার বিষয়গুলো চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে : সারজিস

এনসিপি'র উত্তরাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। ছবি : ফেসবুক

ঢাকা, ৬ মে, ২০২৫ (বাসস) : জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো তৈরি করার লক্ষ্যে ফ্যাসিবাদি বা স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতার উপকরণগুলোকে চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে যেন কখনোই কেউ ক্ষমতার একচ্ছত্র আধিপত্য গ্রহণ করতে না পারে।

আজ মঙ্গলবার বিকেলে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের বৈঠক শেষে গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি এ কথা বলেন। জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, সরোয়ার তুষার ও আরমান হোসেন এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

এ সময় সারজিস বলেন, ‘যেসব কারণে ফ্যাসিবাদ গড়ে ওঠে যেমন- এককেন্দ্রিক ক্ষমতা, দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ, পক্ষপাত যুক্ত নির্বাচন ও নিয়ন্ত্রিত বিচারবিভাগ- এসব জায়গাগুলোকে আলাদা করে সংস্কারের কাজ করতে হবে যেন দেশে আর কখনো একটি ফ্যাসিবাদী কাঠামো পুনরায় তৈরি হতে না পারে।’

তিনি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক রীতি ও প্রক্রিয়ার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে জনগণের ভোট ও মতামত ও অংশগ্রহন হবে সার্বিক নীতি নির্ধারণের মূল ভিত্তি। ক্ষমতার ভারসাম্য ও বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যেন কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা দল একচেটিয়া পুরো শাসন ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করতে পারে।’

স্বাধীন নিরপেক্ষ ও কার্যকর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিচার বিভাগ, দুদক, মহাহিসাব নিরীক্ষণ দফতর সহ সংবিধিবদ্ধ সংস্থাগুলোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করে আলোচনা করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সাংবিধানিক সুরক্ষা ও সংস্কার প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সুরক্ষিত করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি গঠনের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, আমরা বিগত সময়ে দেখেছি রাষ্ট্র পরিচালনায় নির্বাহী বিভাগের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিক কাউন্সিলের জবাবদিহিতার আওতায় আসবে নির্বাহী বিভাগ। পাশাপাশি সাংবিধানিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও কাজ করবে এনসিসি।

তিনি জানান, ঐকমত্য কমিশনের সাথে আলোচনাকালে আসন ভিত্তিক দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের নিম্নকক্ষ এবং ভোটের আনুপাতিক হারের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, যেকোনো আন্তর্জাতিক চুক্তির ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষের অনুমোদন লাগবে বলে আমরা প্রস্তাব করেছি।

মৌলিক অধিকার বিরোধী দমনমূলক আইন ও সংবিধানের ৩৩(৩) (নিবর্তন মূলক আটক) আইন এর সংস্কার, ১৯৭৪ সালের  বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিলসহ ফ্যাসিবাদী কাঠামো বিলোপে নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্য দলটির প্রস্তাবিত অন্যান্য  বিষয়গুলো হচ্ছে দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রীর পদে না থাকা, দলনেতা, প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতা হিসেবে পৃথক পৃথক ব্যক্তির নিয়োগ, সংসদের বিরোধী দলের ছায়া ক্যাবিনেট গঠন, দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ভোট এমনকি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট দেয়া, নির্বাচন এর পূর্বে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন এবং সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীর ক্ষেত্রে গণভোট গ্রহনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, আজকের বৈঠকে একটি মূল অংশ ছিল বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার বিধানাবলী নিয়ে আলোচনা। 

তিনি বলেন, এ লক্ষ্যে আমরা বিচার বিভাগের নিজস্ব প্রশাসনিক সচিবালয় গঠন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন, সর্বজ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, আপিল বিভাগে বিচারপতি নিয়োগের নিরপেক্ষ মূল্যায়ন পদ্ধতি অবলম্বন, হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ, ক্ষমতায় যাবার হাতিয়ার নয় বরং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদকের স্বীকৃতি,  সরকারি ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমতি না নেওয়ার বিধান প্রণয়ন ও দুদক আইনের ৩২(ক) ধারা বাতিল, স্থানীয় নির্বাচনে ও সরকার ব্যবস্থা দলীয় নির্বাচন প্রতীক ব্যতীত স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনের অধিকার রক্ষা, রাইট টু রিকল বা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কাজ আশানুরূপ না হলে এলাকার ৬০ ভাগ বা বেশি লোকের মতামতের ভিত্তিতে পুনর্নির্বাচনের ব্যবস্থা- ইত্যাদি আমরা কমিশনকে জানিয়েছি।

সর্বোপরি দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার্থে নাগরিক সেবা নিশ্চিতকরণ আইন প্রণয়ন, বিদ্যমান সিটিজেন চার্টারসমূহের শক্তিশালী আইনি ভিত্তি তৈরি, নাগরিক সেবা প্রদান ও অভিযোগ প্রতিকার নিশ্চিত করতে প্রশাসনিক ন্যায়পাল হিসেবে স্বাধীন সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান নাগরিক সেবা ও অভিযোগ প্রতিকার কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।

তিনি বলেন, আমরা এ ক্ষেত্রে দায়িত্বরত ব্যক্তির কর্মে অবহেলা অথবা অপারগতার ফলে ডি-মেরিট পয়েন্ট যুক্ত করার বিধানের ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাব করেছি। 

তিনি বলেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে নতুন প্রশাসনিক উন্নয়ন এবং সংস্কার বিভাগ গঠন করার প্রস্তাব দিয়েছি। সামগ্রিকভাবে বিষয়গুলো পর্যালোচনা ও পরিচালনা করার জন্য টাস্ক ফোর্স গঠন করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছি। নাগরিক সেবা সময়সীমা নির্ধারণ এবং সময়সীমার মধ্যে কাজ করা না হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহিতা, মূল্যায়ন অথবা শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ১৯ এপ্রিল প্রথম বারের মতো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বসে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।

আজ সকালে দ্বিতীয় দফা আলোচনার শুরুতে রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারের একটি রূপরেখা জাতীয় ঐক্যমত কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ এর হাতে জমা দেয় দলটি।

আলোচনা শুরুতে সূচনা বক্তব্যে অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, আগামী ১৫ মে এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত পাঁচটি সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের বিষয়ে প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনা শেষ করতে চাচ্ছে কমিশন। এরপর দ্রুতই দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরু হবে।