বাসস
  ২৪ মার্চ ২০২২, ২০:৪০
আপডেট  : ২৫ মার্চ ২০২২, ০৯:৩১

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঘটনাবলী স্মরণ করলেন বঙ্গবন্ধু সহকর্মী

॥ আনিসুর রহমান ॥
ঢাকা, ২৫ মার্চ, ২০২২ (বাসস) : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একজন বয়স্ক সহকর্মী বলেছেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার কয়েক ঘন্টার আগে বাংলাদেশের স্থপতি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ওই কালরাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা নিরস্ত্র বাঙালির ওপর দমনাভিযান শুরু করে। ৯৩ বছরের বয়োবৃদ্ধ হাজী গোলাম মোর্শেদ ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর ‘আজ থেকে আমরা স্বাধীন’ ঘোষণাটি স্মরণ করেন। ১৯৭১ সালের গোড়া থেকে কালরাত পর্যন্ত সেই উত্তেজনাকর দিনগুলোতে তিনি বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। হাজী মোর্শেদ হিসেবে সুপরিচিত মোর্শেদ গত বছরের জুন মাসে ৯৩ বছর বয়সে মারা যান।
মৃত্যুর কয়েক মাস আগে বাসস-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুর রহমান ওই সময়কার ঘটনাগুলো ও ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঘটনবলীর চাক্ষুস বিবরণ জানতে ঢাকায় তার আসাদগেটের বাসভবনে গিয়েছিলেন। তখন তিনি ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে জানাতে গিয়ে বলেন, ভবিষ্যৎ জাতির পিতা পাকিস্তানীদের দমন অভিযান শুরুর আগেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁকে গ্রেফতার করা হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই দিন বঙ্গবন্ধু দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বারংবারের অনুরোধ উপেক্ষা করে, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতেই অবস্থান করেন। তিনি আশা করেছিলেন যে, তাঁকে গ্রেফতার করতে পারলে পাকিস্তানী সৈন্যরা নিরস্ত্র সাধারণ বাঙালিদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালাবে না। কিন্তু বাস্তবে তাঁর এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। বঙ্গবন্ধু ইংরেজিতে বলেন, ‘তারা (পাকিস্তানী সৈন্য) আমাকে গ্রেফতার করতে আসছে। কিন্তু আমি এখানে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
মোর্শেদ বলেন, কয়েক মিনিট পর সেনা কমান্ডোরা আসে, পরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর এলিট ফোর্স স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ (এসএসজি) সদস্যরা ওই বাড়িতে এসে গুলি বর্ষণ শুরু করে ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে। তিনি জানান, রাত ১০টার দিকে বঙ্গবন্ধু একা তাঁর ঘরে বসে চোখ বন্ধ করে ওই ঘোষণাটি প্রদান করেন। সেনা হামলার আশঙ্কায় বেগম মুজিব ও তাঁদের ছোট সন্তান শেখ রাসেল এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী জানান, চরম যুদ্ধংদেহীভাবে সেনাবাহিনী ওই বাড়িতে হামলা চালানোর কিছু সময় আগে অপরিচিত এক ব্যক্তি ফোনে বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলতে চান। মোর্শেদ বলেন, ওই ব্যক্তি ফোনে শুধু এটুকু জানান যে তিনি ‘বলধা গার্ডেন’ থেকে ফোন করেছেন এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে তার কথা বলা খুবই জরুরি। ‘স্বাধীনতার ঘোষণাটি সম্প্রচারিত হওয়ায়’ এখন করনীয় সম্পর্কে তিনি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা চান। মোর্শেদ বলেন, ‘তখন আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে যাই এবং রিসিভারটি আমার হাতে রেখে ওই ব্যক্তির কথা বঙ্গবন্ধুকে বলি। তিনি ওই লোকটিকে লুকিয়ে যেতে এবং ট্রান্সমিটারটি ধ্বংস করে ফেলতে বলেন। আমি আজও ওই ব্যক্তির পরিচয় জানতে পারিনি।’
আসাদগেটের বাসভবনে আধশোয়া অবস্থায় ওই ঘটনাগুলো স্মরণ করছিলেন সাদা চুলের মোর্শেদ। তিনি বলেন, ওই দিন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং আরো অনেকের সাথেই বঙ্গবন্ধু দেখা করেন।   এমনকি সরকারি কর্মকর্তারাও আসেন তাঁর নির্দেশনা নিতে, যারা এসময়টাতে এক অশুভ লক্ষণ দেখতে পান। কিন্তু ছাত্রনেতা তাবিবুর রহমান ছিলেন ওই সময়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করা সর্বশেষ ব্যক্তি। অন্য অনেকের মতো তিনিও বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে তাঁকে আত্মগোপন করার অনুরোধ জানান। মোর্শেদ বলতে থাকেন, ‘তিনি (তাবিবুর) বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘এই মুহূর্তে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যান, তারা (পাকিস্তানী সৈন্য) আপনাকে হত্যা করবে। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন- ‘যদি তারা আমাকে না পায়, তবে তারা সাধারণ মানুষের উপর হত্যাযজ্ঞ চালাবে ও শহরটিকে ধ্বংস করে ফেলবে।’ বঙ্গবন্ধুকে কিছুতেই বাড়ি ছাড়তে রাজি করাতে না পেরে ‘অশ্রুসিক্ত চোখে তাবিবুর ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।’
মোর্শেদ জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা এমএ আউয়ালের কথা স্মরণ করেন- যিনি ওই সময়ে প্যারা-পুলিশ আনসার ফোর্সের পরিচালক  (জেনারেল) ছিলেন। ওই দিন তিনিও বঙ্গবন্ধুর দর্শনার্থীদের একজন ছিলেন। নেতারা যখন বাড়ির ভেতর পরিস্থিতি নিয়ে পর্যালোচনা করছিলেন, তিনি তখন বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। মোর্শেদ বলেন, এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ নেতা ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের কাছে আসন্ন সেনা অভিযান মোকাবেলার জন্য অস্ত্র কোথা থেকে পাওয়া যেতে পারে, তা জানতে চান। তখন আউয়াল পুলিশ অস্ত্রাগারে থাকা অস্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে বলে মত দেন। মোর্শেদ জানালেন, ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান প্রস্তাবটি বাতিল করে দেন। কিন্তু পরে বঙ্গবন্ধু সামরিক অভিযান ঠেকাতে পুলিশ সদস্যদের মাঝে অস্ত্র বিতরণ করতে বলে তার পক্ষ থেকে আউয়ালকে মোর্শেদের সাথে ঢাকার তৎকালীন পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট  ই এ চৌধুরির কাছে পাঠান।
মোর্শেদ বলেন, রাত ১২টার পর, বঙ্গবন্ধু তার কাছে এসে উজ্জ্বল আলোগুলো কোন দিক থেকে আসছে তা জানতে ওপরতলায় চলে যান। কয়েক মুহূর্ত পর, কেউ একজন চিৎকার করে বলল, ‘হ্যান্ডস আপ। অপর একজন বলল, ‘মাৎ মারো (হত্যা করো না)’। এ সময় বঙ্গবন্ধু সিঁড়ির পাশে রাখা টেলিফোন সেটের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ‘এক সেকেন্ডের মধ্যে কেউ একজন কিছু দিয়ে আমার মাথার পিছে আঘাত করলে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।’
মোর্শেদ বলেন, তিনি ১৯৪৬ সালে আজাদ হিন্দ ক্যাপ্টেন রশিদ আলী দিবস থেকেই ‘মুজিব ভাইয়ের’ ভক্ত, যখন বঙ্গবন্ধু কোলকাতার একজন ছাত্রনেতা ছিলেন। পরের বছরগুলোতে ও ১৯৭১ সালের ঘটনাবহুল মার্চ মাসে তিনি বঙ্গবন্ধুর অন্যতম ঘনিষ্ঠ নির্ভরযোগ্য সঙ্গী হয়ে উঠেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত থাকতেন।
মোর্শেদ ১৯৪৯ সালে স্কুরে পড়াশুনা শেষ করে, যশোরের এমএম কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি কলেজ ইউনিয়ন নেতা হয়ে ওঠেন এবং পরবর্তীতে জেলা মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন। পাশাপাশি ১৯৫৩ সালে তিনি জিলা বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হন, তখন তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৫৫ সাল থেকে ৬২ সাল পর্যন্ত তিনি যশোর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
ব্যবসা উপলক্ষ্যে ১৯৬৪ সালে ঢাকায় আসার পর বঙ্গবন্ধুর সাথে তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে।

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়