বাসস
  ২২ অক্টোবর ২০২৫, ১৯:১৪

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ আরও কঠিন অধ্যায়ের সূচনার ইঙ্গিত দিচ্ছে: আইসিসিবি 

ঢাকা, ২২ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস): ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অফ কমার্স, বাংলাদেশ (আইসিসিবি) পর্যবেক্ষণ করেছে, ২০২৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হচ্ছে। তবে এই উত্তরণ আরও কঠিন অধ্যায়ের সূচনা করবে। এতে দরকার হবে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কার এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার আরও বেশি সক্ষমতা। 

আইসিসিবি’র ত্রৈমাসিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২৫) বুলেটিনের সম্পাদকীতে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। 

সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ এখন এক ঐতিহাসিক বাঁকে দাঁড়িয়ে আছে। জাতিসংঘের নির্ধারিত তিনটি সূচক জনপ্রতি ব্যক্তির আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ঝুঁকি সূচক গুলোতেই সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে দেশটি। ফলে ২০২৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উঠতে যাচ্ছে। এই অর্জন আমাদের জন্য এক বিশাল গর্বের বিষয়, যা গত পঞ্চাশ বছরের উন্নয়ন, শিল্পের অগ্রগতি ও সামাজিক পরিবর্তনের প্রতিফলন।

এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে সম্পাদকীয়তে বলা হয়, উত্তরণের পর বাংলাদেশ ধীরে ধীরে এখনকার শুল্কমুক্ত ও কোটা-মুক্ত বাজার সুবিধা বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো বড় রপ্তানি গন্তব্যে হারাবে। তৈরি পোশাক খাত (আরএমজি), যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি, সেখানে ১০-১২ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ হতে পারে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অনেকটা কমে যেতে পারে। যদি উৎপাদনশীলতা না বাড়ে এবং নতুন বাজার বা উচ্চমূল্যের পোশাক পণ্যে বৈচিত্র্য আনা না যায়, তবে এই খাতের বর্তমান সুবিধাজনক অবস্থান হারানোর ঝুঁকি রয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, বৈশ্বিক বাণিজ্যের বর্তমান প্রবণতা এই চ্যালেঞ্জকে আরও জটিল করে তুলছে। বিশ্বজুড়ে বাড়ছে সুরক্ষাবাদ, কঠিন সরবরাহ শৃঙ্খল মানদণ্ড এবং অশুল্ক বাধা যেমন কার্বন ট্যাক্স ও শ্রম-পর্যবেক্ষণ আইন। এসব কারণে প্রচলিত রপ্তানি পদ্ধতি এখন ঝুঁকির মুখে। বিশ্বের পোশাক বাজার এখন পরিবেশবান্ধব উৎপাদন, পণ্যের উৎসের স্বচ্ছতা এবং শ্রমমান বজায় রাখার ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তাই বাংলাদেশকে দায়িত্বশীল ও উদ্ভাবনী এক উৎপাদনকেন্দ্র হিসেবে নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে হবে।

সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়, উত্তরণের পর বাংলাদেশ আর কম সুদে ঋণ বা অনুদান পাবে না। ফলে দেশকে ব্যয়বহুল বাণিজ্যিক ঋণের ওপর নির্ভর করতে হবে।

ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি, আর বৈশ্বিক সুদের হার বাড়ায় সেই ঋণ পরিশোধ করাও আরও কঠিন হয়ে উঠছে। এই অবস্থায় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে দরকার হবে শক্তিশালী ঋণ ব্যবস্থাপনা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি এবং রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনা, যাতে দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় থাকে।

এলডিসি থেকে উত্তরণে বিভিন্ন করণীয় তুলে ধরে সম্পাদকীয়তে বলা হয়, দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন ধরে রাখতে সাহসী কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দরকার। কর ও শুল্ক প্রক্রিয়া সহজ করা, চুক্তি বাস্তবায়নের কার্যকারিতা বাড়ানো এবং ডিজিটাল প্রশাসন সম্প্রসারণ করা হবে মানসম্মত বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে, নিয়ম-নীতির স্বচ্ছতা ও দ্রুত সেবাদান নিশ্চিত করতে হবে, যাতে দেশে ব্যবসা পরিচালনা আরও সহজ ও কার্যকর হয়।

এতে আরও বলা হয়, একই সময়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষার দুর্বল দিকগুলো দূর করতে হবে, যাতে উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছায়। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশ আর মানবসম্পদকে পিছিয়ে রাখতে পারবে না। দক্ষতা উন্নয়ন, কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এই তিনটি দিকই নির্ধারণ করবে উন্নয়নের ফল কতটা ন্যায্যভাবে ভাগ হবে তার ওপর।

সম্পাদকীয়তে বলা হয়, এলডিসি উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য নতুন সুযোগও এনে দিচ্ছে, শুধু পোশাক খাতেই সীমাবদ্ধ না থেকে তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি), ওষুধশিল্প, চামড়া, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ, সেবা খাত ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বৈচিত্র্য আনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই খাতগুলো দীর্ঘমেয়াদে প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা ধরে রাখতে এবং নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

এতে আরও পরামর্শ দিয়ে বলা হয়, রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে ওষুধ শিল্পকে গবেষণা ও উন্নয়ন (আরএন্ডডি)-এ বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, উৎপাদনকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিওএইচও-জিএমপি) মানে উন্নীত করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়তে হবে। এই পরিবর্তনের সময়ে সরকারকে প্রণোদনা, রপ্তানি সহায়তা ও উদ্ভাবন তহবিলের মাধ্যমে শিল্পখাতকে সমর্থন দিতে হবে, যাতে বাংলাদেশ পরিমাণভিত্তিক রপ্তানি থেকে মানভিত্তিক রপ্তানির দিকে এগিয়ে যেতে পারে।

আইসিসিবি বলেছে, বাংলাদেশের আসন্ন এলডিসি উত্তরণ নিঃসন্দেহে উদ্‌যাপনের মতো একটি মাইলফলক। তবে একই সঙ্গে এটি একটি নতুন দায়িত্বেরও ডাক। অতীতের সুবিধাগুলো ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাবে, আর ভবিষ্যতের পথে এগোতে হলে দরকার হবে আরও বেশি সংস্কার, আরও বেশি উদ্ভাবন এবং সংকট মোকাবিলার আরও শক্তিশালী সক্ষমতা।

এই বাস্তবতা বিবেচনা করে আইসিসি বাংলাদেশ ও দেশের ১৫টি প্রধান বাণিজ্য সংগঠন গত ২৪ আগস্ট এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ ৩ থেকে ৫ বছর পিছিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। তাদের মতে, এতে শিল্পখাত নিজেদের সক্ষমতা পুনর্গঠন, প্রতিযোগিতা শক্তি পুনরুদ্ধার এবং প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়নের যথেষ্ট সময় পাবে। এই অতিরিক্ত সময় অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করবে এবং বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা ও দেশীয় পুনরুদ্ধারের চ্যালেঞ্জের মধ্যেও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনবে।

আইসিসিবি মনে করে, সমন্বিত নীতিগত সংস্কার, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি খাতের উদ্যমী নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশ এই উত্তরণের সময়কে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই ও স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির পথে বড় সুযোগে পরিণত করতে পারে। এভাবেই প্রমাণ করা যাবে, দুর্বলতা থেকে দৃঢ়তার পথে বাংলাদেশের যাত্রা শুধু প্রশংসনীয় নয় বরং একেবারে অপ্রতিরোধ্য।