শিরোনাম
।। মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন।।
ফেনী, ১৬ অক্টোবর ২০২৫ (বাসস):এবার ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে এই জেলার বিখ্যাত ‘খন্ডলের মিষ্টি’। ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলার চারিগ্রামের খন্ডল হাই এলাকায় তৈরি হয় এই মিষ্টি।
জেলা শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে একটি ছোট্ট বাজারের নাম ‘খন্ডল’। ১৯৭১ সালে এই বাজারের নামেই নামকরণ হয়েছিল ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টির। সুস্বাদু এ মিষ্টি প্রথম তৈরি করেছিলেন ভাগ্যান্বেষী যোগল চন্দ্র দাস।
খন্ডল বললেই ফেনীর মানুষ দূরের কোনো এলাকাকে বোঝে। আর এমন এক প্রত্যন্ত এলাকায় তৈরি হওয়া মিষ্টি সুনাম ছড়াচ্ছে জেলা ছাড়িয়ে দেশবিদেশে। এবছর জিআই পণ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে আবেদন করেছে ফেনীর বিখ্যাত ‘খন্ডলের মিষ্টি’। ‘খন্ডলের মিষ্টি’ দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনবে ফেনীবাসীর এমনই প্রত্যাশা। ফেনীর বিখ্যাত ‘খন্ডলের মিষ্টি’ প্রচলিত রসগোল্লার মতোই সুস্বাদ ও সুনাম জেলা ও দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে পৌঁছেছে। এটি মূলত রসগোল্লার একটি ভিন্ন সংস্করণ।
পরশুরাম উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, খন্ডলের পাটোয়ারী মিষ্টি মেলার স্বত্বাধিকারী মো. বেলাল হোসেন পাটোয়ারী খন্ডলের মিষ্টিকে জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছেন। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৭ আগস্ট ২০২৫ তারিখে পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহরিয়া ইসলাম স্বাক্ষরিত এক পত্রে খন্ডলের মিষ্টিকে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি প্রদানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হয়েছে।
স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মী এম এ হাসান বাসসকে বলেন, সত্তরের দশকের শেষভাগে ভাগ্যান্বেষণে বাড়ি ছাড়েন যোগল। ভায়রার ডাকে বসতি গড়েন পরশুরামের খন্ডল হাই বাজারের পার্শ্ববর্তী বণিক পাড়ায়। শুরুতে খন্ডল হাই বাজারে ছোট্ট চায়ের দোকান খোলেন। নাস্তা খেতে আসা ক্রেতাদের জন্য কিছু মিষ্টিও তৈরি করতে থাকেন। মোট ৫২ ধরনের মিষ্টি বানাতে পারতেন যোগল। তার মিষ্টি বানানোর পারদর্শিতার কথা জানতে পেরে তার কিছু সাগরেদ জুটে যায়। এরমধ্যে যোগল দাসের দোকানের স্পঞ্জের মিষ্টির খ্যাতি আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে যোগল চন্দ্র দাস ব্যাবসা ছেড়ে চলে গেলেও তার সাগরেদরাই ধরে রাখেন মিষ্টির ঐতিহ্য। যোগলের সাগরেদদের মধ্যে অন্যতম কবির আহম্মদ পাটওয়ারী। মূলত তার হাত ধরেই খন্ডলের এই সুস্বাদু মিষ্টির সুনাম ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে বিস্তৃত এলাকায়। বছর দুয়েক আগে মারা যান কবির আহমদ। বর্তমানে তার সন্তানরা ধরে রেখেছেন খন্ডলের মিষ্টির আভিজাত্য।
খন্ডলের মিষ্টির কারিগরদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আশপাশের গ্রাম থেকে কলসি, প্লাস্টিকের ড্রাম, বোতল ও হাঁড়িতে করে দুধ আসে কারখানায়। প্রথমে সুতি কাপড়ে কাঁচা দুধ ছেঁকে নেয়া হয়। এরপর চুলায় চাপানো হয় ১৭ কেজি দুধ। আধঘণ্টা জ্বাল দেওয়ার পর চুলা থেকে নামানো হয় সেই দুধ। তারপর উষ্ণ দুধে টক পানি ও কিছুটা বিশুদ্ধ ঠান্ডা পানি মিশিয়ে দুধের ছানা তৈরি করা হয়। সুতি কাপড়ের মাধ্যমে ছানা আলাদা করা হয়। ১৭ কেজি দুধ থেকে পাওয়া যায় দুই কেজি ছানা। শুকানো ছানা থেকে শুরু হয় মিষ্টি তৈরির প্রক্রিয়া। প্রথমে হাত দিয়ে পুরো ছানা দলা করে মেশানো হয় ২০ গ্রামের মতো ময়দা। তারপর ৬ লিটার বিশুদ্ধ পানি হালকা জ্বাল করে তাতে পাঁচ কেজি চিনি মেশানো হয়। উচ্চ আঁচে ১৫ মিনিটের মতো জ্বাল দেওয়া হয়। তারপর চিনির রস ছেঁকে আবারও চুলায় দিয়ে তাতে মিষ্টির মন্ডগুলো ছেড়ে দিয়ে আধঘণ্টা জ্বাল দেওয়া হয়।
স্থানীয়রা জানায়, ফেনীর নানা প্রান্তে খন্ডলের মিষ্টির নামে অসংখ্য দোকান পাওয়া গেলেও মূলত এ বাজারের দুটি দোকানেই তৈরি হয় আসল খন্ডলের মিষ্টি। দোকান দুটির একটি কবির আহাম্মদ পাটোয়ারীর ‘খন্ডলের পাটোয়ারী মিষ্টি মেলা’ ও অন্যটি দেলোয়ার হোসেনের ‘খন্ডলের আসল মিষ্টি মেলা’।
খন্ডলের পাটোয়ারি মিষ্টি মেলার স্বত্বাধিকারী মো. বেলাল হোসেন পাটওয়ারী বাসসকে বলেন,‘ আমার বাবা কবির হোসেন পাটোয়ারি ১৯৭১ সালে এ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু করেন। বাবার অনুপস্থিতিতে আমি এই ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছি।’
তিনি জানান, ‘খন্ডলের মিষ্টির অন্যতম বিশেষত্ব হল প্রায় সব মিষ্টি ঠান্ডা অর্থাৎ স্বাভাবিক তাপমাত্রায় খাওয়া হলেও খন্ডলের মিষ্টি খাওয়া হয় গরম এবং ঠান্ডা উভয় অবস্থাতেই সুস্বাদু। রসসহ প্রতি কেজি মিষ্টি বিক্রি হয় ১৬০ টাকায়। রস ছাড়া প্রতি কেজি মিষ্টি বিক্রি হয় ২৬০ টাকায়।
তিনি আরও বলেন, ‘দিনে ১৫০ কেজির মতো মিষ্টি তৈরি হয়। চাহিদা বেশি হলেও আমরা গুণমানে বিশ্বাসী। মিষ্টির মান ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে পেরে আমরা সন্তুষ্ট।’
খন্ডলের মিষ্টির উদ্ভাবক যোগল চন্দ্র দাস বাসসকে বলেন, ‘এ মিষ্টির প্রধান ও একমাত্র উপকরণ হলো গরুর খাঁটি দুধের ছানা। এখানে গোপন কোনো ফরমুলা নেই। অনেক চাহিদা থাকা স্বত্বেও প্রতিদিন ১৫০ কেজির বেশি মিষ্টি তৈরি করা হয় না। কারণ তাতে মিষ্টির গুণগত মান নষ্ট হয়।’
পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৬০ তম পণ্য হিসেবে সর্বশেষ ২০২৪ সালের ১ আগস্ট জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে ফরিদপুরের পাট। সেই বিবেচনায় খন্ডলের মিষ্টি হতে পারে দেশের ৬১তম জিআই সনদপ্রাপ্ত পণ্য।