শিরোনাম
ঢাকা, ৭ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন, জাতীয় ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদ (এনটিসিসি) পুনর্গঠন এবং বাংলাদেশ শ্রম আইন সংশোধন প্রক্রিয়া শুরু করাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে শ্রমিকদের অধিকার, নিরাপত্তা ও ন্যায্য মজুরির বিষয়গুলোর ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
২০২৪ সালের ১৭ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার শ্রম খাতে যথাযথ সংস্কার নিশ্চিত করতে ১০ সদস্যের একটি শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করে। এতে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)-এর নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদকে প্রধান করা হয়।
শ্রমিকদের অধিকার, নিরাপত্তা এবং ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে সংস্কারমূলক প্রস্তাব দেওয়ার জন্য এ কমিশন গঠন করা হয়।
এ কমিশন ২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তাদের প্রতিবেদন হস্তান্তর করে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, একটি স্থায়ী শ্রম কমিশন গঠন করে তা আইনগত সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলা দরকার, যাতে জবাবদিহিমূলক শ্রম প্রশাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে শ্রম মন্ত্রণালয় একটি ‘জাতীয় সামাজিক সংলাপ ফোরাম’ গঠন করবে।
প্রতিবেদনে কমিশন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দক্ষতা উন্নয়নের উদ্যোগ নিতে সরকারকে সুপারিশ করেছে, যাতে দেশে ও বিদেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মাধ্যমে বেকারত্ব হ্রাসে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
অটোমেশন ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কমিশনের প্রতিবেদনে সরকারকে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রোডম্যাপ প্রণয়নের পরামর্শ দেওয়া হয়, যাতে একটি দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করা যায়। প্রতিবেদনে উৎপাদনমুখী যুব শ্রমশক্তি ও উদ্যোক্তা তৈরির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা প্রসঙ্গে কমিশন সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।
গত এক বছরের মধ্যে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশে জাতীয় ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদ (এনটিসিসি) পুনর্গঠন করা হয়েছে, যাতে এর কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় এবং শ্রমিক ও মালিক পক্ষের প্রতিনিধিত্ব আরও সমতাভিত্তিক হয়। এই পুনর্গঠনের লক্ষ্য ছিল শ্রম খাতে সংস্কারে পরিষদের ভূমিকা শক্তিশালী করা এবং সরকার, মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে আরও কার্যকর সংলাপ উৎসাহিত করা।
বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, এনটিসিসি সরকারের পাশাপাশি মালিক ও শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি ত্রিপক্ষীয় সংস্থা হিসেবে কাজ করে, যা শ্রম সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটায়।
এনটিসিসির এই পুনর্গঠন বাংলাদেশে শ্রম খাতকে আধুনিকায়ন ও শক্তিশালী করার একটি বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ, যার মধ্যে রয়েছে শ্রম আইন সংস্কার, শ্রম পরিদর্শন জোরদারকরণ এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নির্দেশনা অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়নবিরোধী বৈষম্যের মোকাবিলা। পুনর্গঠনের পর ২০২৫ সালে এনটিসিসি তিনবার বৈঠক করেছে এবং বিভিন্ন শ্রম সংগঠন এ পরিবর্তনকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে।
সরকার সেপ্টেম্বরের মধ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সনদ অনুমোদনের অঙ্গীকার করেছে। এই সনদগুলো হলো— কনভেনশন ১৫৫ (কর্মস্থলের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য), কনভেনশন ১৮৭ (কর্মস্থলে নিরাপত্তা বৃদ্ধির কাঠামো) এবং কনভেনশন ১৯০ (কর্মস্থলে সহিংসতা ও হয়রানি দূরীকরণ)।
কনভেনশন ১৫৫ ও ১৮৭-এর অনুমোদন প্রক্রিয়া নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী অগ্রসর হচ্ছে এবং এ পর্যন্ত এটি বড় কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়নি। সরকার এসব সনদের বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ।
২০২৪ সালের শেষ দিকে সরকার আইএলও এবং প্রধান বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে নতুন শ্রম আইন খসড়া প্রণয়ন করে। সংশোধিত এই আইন অধ্যাদেশ আকারে কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে।
সরকারের আশা করছে, সংশোধিত এই আইন শ্রমিক সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিতকরণে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলো (ইপিজেড) দীর্ঘদিন ধরে একটি পৃথক শ্রম ব্যবস্থার আওতায় পরিচালিত হয়ে আসছে, যেখানে জাতীয় শ্রম আইন থেকে ছাড় প্রদান করা হয়েছে।
সরকার দুটি ধাপে আইনটি সংশোধনের পরিকল্পনা করেছে। প্রথম ধাপে সংশোধিত বাংলাদেশ শ্রম আইন (বিএলএ) কার্যকর হবে এবং দ্বিতীয় ধাপে ইপিজেড আইনটি সংশোধিত বিএলএ-এর মূল সুরক্ষামূলক বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলা হবে।
এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হলো— শ্রম আইন ও নীতিমালার বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ প্রদানে পরিষদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সামাজিক সংলাপকে উৎসাহিত করা এবং শান্তিপূর্ণ শিল্প-সম্পর্ক উন্নীত করা।
২০০৬ সালের বাংলাদেশ শ্রম আইন (২০১৮ সালে সংশোধিত) সংশোধনের প্রক্রিয়া বর্তমানে চলমান রয়েছে এবং এতে জাতীয় ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদের (এনটিসিসি) সুপারিশসমূহ অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে কাজ চলছে।
চলতি বছরের ২৪ জুন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ‘সবুজ কারখানা পুরস্কার ২০২৫’ প্রদান করেছে। পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম, জ্বালানি দক্ষতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং সামগ্রিক কর্মপরিবেশ বজায় রাখার প্রতিশ্রুতির স্বীকৃতি স্বরূপ ১৬টি ক্যাটাগরিতে ৩০টি কারখানাকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়।
এ বছরের পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, চামড়া, ওষুধ, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, ইস্পাত, জাহাজ ভাঙা এবং বৈচিত্র্যময় উৎপাদন খাত।
২০২৫ সালের মার্চে জেনেভায় আইএলও’র ৩৫৩তম গভর্নিং বডি অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন শ্রম ও কর্মসংস্থান বিষয়ক উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্য ও অংশীজনদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে টেকসই শ্রম সংস্কার বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি আরও বলেন, শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অধিকাংশ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা সরকার প্রত্যাহার করেছে এবং ত্রিপক্ষীয় কমিটিগুলোতে শ্রমিক ও মালিক পক্ষের গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করেছে।
উপদেষ্টা জানান, শ্রম আইনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীতে ত্রিপক্ষীয় ঐকমত্য হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ব্যবস্থাপনা, তত্ত্বাবধায়ন ও প্রশাসনিক পর্যায়ের কর্মীদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার সম্প্রসারণ।
তিনি বলেন, ইপিজেড শ্রম আইন সংশোধনের জন্যও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা চলছে, যাতে তা সংশোধিত শ্রম আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। উভয় আইনের তুলনামূলক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন আরও জানান, বর্তমানে কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে মোট পরিদর্শনের ৫০ শতাংশই স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) অনুযায়ী ঘোষণাবিহীনভাবে পরিচালিত হচ্ছে। তিনি শ্রম পরিদর্শক পদের শূন্যতা দ্রুত পূরণ করা হবে বলে আশ্বাস দেন।
আলোচনাকালে এশিয়া ও আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের শ্রম সংস্কারের প্রশংসা করেন এবং দেশের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তির আহ্বান জানান।
উল্লেখ্য, গত পাঁচ বছরের চলমান পর্যালোচনায় এই প্রথমবারের মতো আইএলও’র সদস্য রাষ্ট্রভুক্ত আরব গ্রুপ সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে, যা আইএলওর কার্যক্রমে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এছাড়াও আরও ১৮টি দেশ স্বতন্ত্রভাবে বাংলাদেশের শ্রম সংস্কারের প্রশংসা করেছে, যা এ পর্যন্ত পাওয়া সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক সমর্থনের নিদর্শন।
চলতি অধিবেশনে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-এর গভর্নিং বডির কোনো সদস্যই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তদন্তের আহ্বান জানাননি।
বাংলাদেশের প্রতিবেদন ও অধিবেশনে আলোচনার ভিত্তিতে চলমান অভিযোগের পরবর্তী শুনানি ২০২৫ সালের নভেম্বর থেকে পিছিয়ে ২০২৬ সালের মার্চে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, যা সহযোগিতামূলক মনোভাবের একটি গঠনমূলক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের শুভেচ্ছা সফর বাংলাদেশ সরকারের শ্রম অধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতির স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
তিনি আইএলও’র ত্রিপক্ষীয় দলসহ অন্যান্য প্রতিনিধিদলকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান, যাতে তারা সরেজমিনে সরকারের চলমান শ্রম খাত সংস্কার কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করতে পারেন।
ড. সাখাওয়াত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চলমান মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সমর্থন জানাতে আহ্বান জানান।
অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের শ্রম আইন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মান অনুযায়ী, বিশেষত সংগঠনের স্বাধীনতা ও যৌথ দরকষাকষির অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
সরকারের সার্বিক লক্ষ্য হলো— একটি ন্যায়সঙ্গত ও সমতা-ভিত্তিক শ্রমবাজার তৈরি করা, যা শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষিত রাখবে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং একটি নতুন নির্বাচিত সরকারের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবেশ তৈরি করবে।
শ্রম আইন কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের জন্য শ্রম অধিদফতর এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
২০২৫ সালের ২০ জুন এক অনুষ্ঠানে শ্রম ও কর্মসংস্থান বিষয়ক উপদেষ্টা জানান, সরকার চলতি বছরের অক্টোবরের মধ্যেই বাংলাদেশ শ্রম আইন সংশোধন সম্পন্ন করবে। কারণ এই আইনকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি আরও বলেন, এই আইন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাকে (আইএলও) উপস্থাপন করা সম্ভব হবে, যা শ্রম অধিকার উন্নয়নের একটি প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে।