শিরোনাম
\ দিদারুল আলম \
ঢাকা, ১৫ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : 'জুলাই উইমেন্স ডে’ উপলক্ষ্যে ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজনে চব্বিশের জুলাইয়ের সাহস ও বিপ্লবের গাথাকে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) সংলগ্ন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গতকাল বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত চলে ব্যতিক্রমধর্মী এ আয়োজন। হাজারো ড্রোন ফুটিয়ে তুললো চব্বিশের জুলাইয়ের সাহস আর বিপ্লবের গাথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ অগণিত মানুষ বিমোহিত দৃষ্টিতে তা অবলোকন করেন।
ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত সাড়ে এগারোটা। জুলাই গণ অভ্যুত্থানের ১৪ জুলাই পুর্নজাগরণের অনুষ্ঠান তখন চলছিল। হঠাৎ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পশ্চিম আকাশ থেকে রংবেরঙের আলো জ্বালিয়ে ভেসে আসে দুই হাজার ড্রোন। এক অপূর্ব দৃশ্যের আলোকছায়ার মধ্যে জ্বলজ্বল করে উঠল সাহস, সংগ্রাম আর স্মৃতির অবারিত মুখ।
এ সময় আগত হাজারো মানুষ ও উল্লসিত ছাত্র জনতা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন আকাশের দিকে। মুহূর্তেই পিন পতন নিরবতার মধ্যে সবার হাতে মোবাইল ক্যামেরা চালু হয়ে যায়। শুরু হয় ড্রোনের খেলা।
এ সময় আলোকসজ্জা ও কারুকার্যময় ড্রোনের এই প্রদর্শনীতে একে একে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সময়ের খুন, গুম, হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, নৈরাজ্যসহ নানা বিষয় উঠে আসে। ড্রোনের আলো দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয় নারী অবদানের নানা প্রতীক ও বার্তা।
আকাশ সীমানায় উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো ভেসে ওঠে ১৪ই জুলাই এর প্রতিচ্ছবি। এরপর পর্যায়ক্রমে আকাশে ভেসে ওঠে পিলখানায় বিডিআর হত্যাকাণ্ড, গুম হওয়া ইলিয়াস আলী, আরমান, মাইকেল ও সুমনের ছবি। তুলে ধরা হয় শাপলা হত্যাকাণ্ড, আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড, সরকারের মদদ পুষ্ট লুটপাট কারীদের ছবি, লাইলাতুল ইলেকশন, পোস্ট ডিলিট করো, ১৪ জুলাই, তাহলে কি রাজকারের নাতিপুতিরা পাবে? তুমি কে, আমি কে, জন্মভূমি অথবা মৃত্যু, শোনো মহাজন, আমরা অনেকজন-এসব স্লোগান তুলে ধরা হয় প্রায় দশ মিনিটের এই ড্রোন প্রদর্শনীতে। প্রদর্শনী শেষে ড্রোনগুলো ফিরে যায় পশ্চিম আকাশে। পরে সমবেত ও একক সংগীত পরিবেশন এর মধ্য দিয়ে গণঅভ্যুত্থানের ১৪ জুলাই পুনর্জাগরণের অনুষ্ঠান শেষ হয়।
এর আগে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমবেত কন্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানটি শুরু হয়।
‘জুলাই উইমেন্স ডে’ উপলক্ষে গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি পুনর্জাগরণে জুলাই বিপ্লবী সংগীত শিল্পী ও জুলাই যোদ্ধা ফারজানা ওয়াহিদ সায়ানের কন্ঠসহ জুলাই যোদ্ধাদের স্মৃতিচারণে উঠে আসে, ‘যারা জুলাই স্বীকার করে না, তারা আমাদের কেউ না। জুলাই কারো একার না। জুলাই বিপ্লব আমাদের সবার। আমরা জুলাই বিক্রি করি না, কাউকে বিক্রি করতেও দেবো না।’
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় নির্মিত একটি ডকুমেন্টারিও প্রদর্শিত হয়। এরপর দিপক কুমার গোস্বামীর ‘স্পিকিং’ ও ‘জুলাই বিষাদ সিন্ধু’ চলচ্চিত্রসমূহ যথাক্রমে প্রদর্শিত হয়।
বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেই ‘জুলাই উইমেন্স ডে’ অনুষ্ঠান উপভোগ করেন আইন সংসদ ও বিচার বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, সমাজকল্যাণ এবং নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, গৃহায়ণ ও গণপুর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. নিয়াজ আহমেদ খান, নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক লতিফুল ইসলাম শিবলী, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও উপ প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার। এছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।
জুলাই যোদ্ধা সায়ান ‘এই মেয়ে শোন’, ‘আমি জুলাইয়ের গল্প বলবো’, ‘আমার নাম প্যালেস্টাইন’, প্রভৃতি জনপ্রিয় গান পরিবেশন করেন।
অনুষ্ঠানে, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নারীরা যেভাবে মাঠে নেমে এসেছিলেন সেই দিনগুলো নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন শহীদ নাইমা সুলতানার মা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও জুলাই যোদ্ধা সায়মা ফেরদৌস ও উমামাসহ অনেকে।
জুলাই যোদ্ধারা বলেন, হাজার প্রাণের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা পেয়েছি, যে স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি, এই স্বাধীন দেশে আমরা নারীরা স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে চাই।
তারা বলেন, এ দেশে কথা বলার স্বাধীনতা চাই, নারী ও পুরুষের সমান অধিকার চাই, নারীদের ওপর যেন আর কোন অত্যাচার ও নিপীড়ন, ধর্ষণের ঘটনা না ঘটে সরকার সেই ব্যবস্থা নেবে এটাই আমরা আশা করবো। অন্যথায় জুলাই যোদ্ধারা আবারও শতগুণ হয়ে পথে নেমে প্রতিবাদ জানাবে এবং নারীর অধিকার অর্জন করতে আন্দোলন করবে। আমরা আর স্বৈরাচার আমলে ফিরে যেতে চাই না।
অনুষ্ঠানে সংগতি’, ‘অচিরজীবির প্রার্থনা’, ‘বাঘের গান’ ও ‘নীল নির্বাসন’ গানসমূহ পরিবেশন করে ব্যান্ডদল ইলা লা লা। চব্বিশের জুলাইয়ে স্লোগান দেয়া মেয়েরা মঞ্চে এসে স্লোগান দেয়ার পর এফ মাইনর পরিবেশন করে ‘আলো আসবেই’, ‘মুক্তি’, ‘ডাহুক’ ও ‘মেয়ে’ গানসমূহ। পরে শহীদ আবরার ফাহাদকে নিয়ে ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। আবারও স্লোগান দেয়া মেয়েরা মঞ্চে এসে স্লোগান দেয়ার পর পারসা মাহজাবীন ‘চলো ভুলে যাই’, ‘মুক্তির মন্দির’ ও ‘মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম’ গান পরিবেশন করেন। ‘আমি বাংলায় গান গাই’, ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’, ‘পলাশীর প্রান্তর’, ‘ঘুরে দাঁড়াও’ ও ‘বাংলাদেশ’ গানসমূহ পরিবেশন করেন শিল্পী এলিটা করিম।
চব্বিশের ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চত্বরে আন্দোলনকারী ছাত্রীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ (বর্তমানে নিষিদ্ধ ঘোষিত)৷ সেদিন হামলার শিকার রক্তাক্ত এক ছাত্রীর ছবি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল৷ ‘জুলাই উইমেন্স ডে’ উদযাপন অনুষ্ঠানে ড্রোন শো-তে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সেই ছবির প্রতিকৃতি।
চব্বিশের ১৪ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্লোগান ওঠে ‘তুমি কে, আমি কে/ রাজাকার-রাজাকার; কে বলেছে রাজাকার/ সরকার-সরকার’, আবার কেউ কেউ স্লোগান দেন, ‘কে বলেছে, কে বলেছে/ স্বৈরাচার-স্বৈরাচার’। 'জুলাই উইমেন্স ডে' উদযাপন অনুষ্ঠানে ড্রোন শো-তে ফুটিয়ে তোলা হয় সেই স্লোগানটিও।৷
তবে জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর পরও নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়নি-এমনটাই মনে করছেন আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী এবং অংশগ্রহণকারী নারীরা। তাদের প্রত্যাশা রাজনীতিতে নারীদের উপস্থিতি কেবল প্রতীকীভাবেই নয়, মতামত ও মেধার মূল্য দিয়ে নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক ও ডিজিটাল মাধ্যমে নারীকে অবমাননা করা বন্ধ করতে হবে। অনুষ্ঠানে জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতিচারণ করেন আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীরা।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক ও এনসিপি নেত্রী নুসরাত তাবাসসুম বলেন, চব্বিশের আগেও রাজনীতি করা নারীদের যে চোখে দেখা হতো, এখনো সেই চোখে দেখা হয়। জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নারীদের ‘পলিটিক্যাল মেয়ে’ বলে আগের সরকারের আমলে ছোট করা হতো, এখনো তা করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জুলাইয়ের স্মৃতিচারণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস। জুলাই আন্দোলন নির্মূলে আওয়ামী শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঢাবির এ শিক্ষকের প্রতিবাদ, তার প্রতিবাদী বক্তব্য ও দৃঢ়তা তখন বিশেষ সাহস ও উদ্দীপনা জুগিয়েছিল।
জুলাইয়ের ‘আসছে ফাগুনে আমরা হবো দ্বিগুণ’ স্লোগানের কথা মনে করিয়ে দিয়ে সায়মা ফেরদৌস বলেন, ‘আমরা এখন শতগুণ, হাজার গুণ। দল থাকবে, মত থাকবে, ভিন্নমত থাকবে। তবে নারীর অবমাননা আর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আবারও বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যাব। কোনো দিন আর এই মাটিতে দ্বিতীয় স্বৈরাচারের আবির্ভাব হবে না।’
এ সময় শহীদ নাইমা সুলতানার মা আইনুন নাহার তাঁর মেয়ের স্মৃতি তুলে ধরেন দর্শকদের সামনে। আবেগঘন পরিবেশে উঠে আসে ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, প্রতিবাদ এবং ত্যাগের গল্প। প্রদর্শন করা হয় চলচ্চিত্র-জুলাই কন্যারা আমরা তোমাদের ভুলবো না ও জুলাই অভ্যুত্থানে চোখ হারানো মাহবুব আলমের ওপর নির্মিত একটি চলচ্চিত্র।
জুলাই অভ্যুত্থানের স্লোগানের স্মৃতিচারণা করতে মঞ্চে ওঠেন আন্দোলনে অংশ নেওয়া সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নারী শিক্ষার্থী। এ সময় তারা ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না’, ‘এক দুই তিন চার, খুনি হাসিনা গদি ছাড়’, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার’, ‘দফা এক দাবি এক, শেখ হাসিনার পদত্যাগ’, ‘আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ প্রভৃতি স্লোগানে জুলাইয়ের স্মৃতিচারণ করেন।
উল্লেখ্য, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মোড় ঘোরানো দিন ছিল ১৪ জুলাই। ‘জুলাই উইমেন্স ডে’ উদযাপন অনুষ্ঠানে ড্রোন শোতে সেটি তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে প্রদর্শন করা হয় ছাত্রলীগের হামলায় নিহত বুয়েট শিক্ষার্থী শহীদ আবরার ফাহাদকে নিয়ে চলচ্চিত্র ইউ ফেইলড টু কিল আবরার ফাহাদ। চলচ্চিত্র প্রদর্শন শেষে কথা বলেন আবরার ফাহাদের ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ। তিনি বলেন, আবরার ফাহাদকে নিয়ে এমন প্রামাণ্যচিত্র করার চেষ্টা কয়েক বছর আগেও করা হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন সরকার ও ছাত্রলীগের হুমকির কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি।
আবরার ফাইয়াজের বক্তব্য শেষে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিজের চোখ হারানোর ঘটনার বর্ণনা দেন গৃহিণী পারভিন। তার বর্ণনায় আন্দোলনে পুলিশি নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘এখন আর কেউ ইব্রাহিমের মা কইয়া ডাকে না, ডাকে কানি বইলা।’
পরে জুলাইয়ের স্মৃতিচারণ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী স্বর্ণা রিয়া। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আরও স্মৃতিচারণ করেন আন্দোলনে আহত ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী সুমাইয়া, আন্দোলনে আহতদের নিয়ে কাজ করা চট্টগ্রামের বাসিন্দা কলি কায়েস, জুলাই আন্দোলনের নারায়ণগঞ্জের সংগঠক ফারহানা মানিক, মাদারীপুরের নেত্রী আনিশা।
এদিকে অনুষ্ঠানে জুলাই যোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের আসনে বসতে দিয়ে উপদেষ্টাগণের মঞ্চের মেঝেতে বসার দৃশ্য সকলের নজর কাড়ে।