বাসস
  ২১ মে ২০২৫, ২২:০২

শহীদ আরমান মোল্লার পরিবারে অনুদানের টাকা প্রাপ্তি নিয়ে বিভ্রান্তি

শহীদ আরমান মোল্লা। ফাইল ছবি

নারায়ণগঞ্জ, ২১ মে, ২০২৫ (বাসস): জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আরমান মোল্লার পরিবারে সরকারি অনুদান প্রাপ্তি নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। আরমানের স্ত্রী সালমা আক্তার ও শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যে বিষয়টি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে পারিবারিক বিরোধই প্রধান কারণ বলে মনে করছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।

ঝালমুড়ি বিক্রেতা আরমান মোল্লা ২০২৪ সালের ২১ জুলাই নরসিংদীর শিলমান্দিতে আন্দোলনরত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।

গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) ‘শহীদ আরমান মোল্লার আদরের ছেলেমেয়েদের ঠাঁই হয়েছে এতিমখানায়’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে সালমা আক্তার দাবি করেন, তিনি কোনো সরকারি সহায়তা পাননি। অপরদিকে, তিনি অভিযোগ করেন, শ্বশুরবাড়ির লোকজন সরকারি অনুদান পেলেও তাকে তা থেকে কোনো অর্থ দেননি।

তবে এই প্রতিবেদনের পর ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ থেকে সালমার নামে ৫ লাখ টাকার চেক হস্তান্তরের তথ্য প্রকাশিত হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সালমা আক্তার বাসসকে বলেন, ‘আমার শ্বশুর একদিন আমাকে ডেকে একটি কাগজে স্বাক্ষর দিতে বলেন। আমি তেমন লেখাপড়া জানি না। ওইটা টাকার চেক ছিল কিনা, বুঝিনি। পরে শ্বশুরবাড়ি থেকে দেড় লাখ টাকা পাই। এটা সরকারি অনুদানের টাকা কিনা আমি জানতাম না ।’

প্রথমে অর্থপ্রাপ্তির বিষয়টি অস্বীকার করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সালমা বলেন, ‘তখন বিষয়টা মনে আসেনি।’ তিনি জানান, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকেও তিনি ২ লাখ টাকা পেয়েছেন। তবে জেলা পরিষদের দেওয়া ২ লাখ টাকার কথা তিনি জানতেন না এবং দাবি করেন, ওই অর্থ শ্বশুরবাড়ির লোকজন নিয়েছেন।

সালমার শাশুড়ি জোবেদা বেগম বাসসকে বলেন, ‘জেলা পরিষদ থেকে আমরা ২ লাখ টাকা পেয়েছি। কিন্তু এর আগে যত টাকা এসেছে, সবটাই সালমা পেয়েছে।’

জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে দেড় লাখ টাকা পাওয়ার সালমার দাবির বিষয়ে জোবেদা বলেন, ‘আমরা ওখান থেকে কোনো টাকা নেইনি। সালমা মিথ্যা বলছে।’

সালমা আক্তারের তিন ছেলে-মেয়ে। এর মধ্যে দুজনকে এতিমখানায় দিয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি। তথ্য যাচাই করে জানা যায়, ছেলে রাফি (৭) নরসিংদী জেলার পাঁচদোনা এলাকার বসন্তপুর হাফিজিয়া মাদরাসায় পড়াশোনা করেন। এই মাদ্রাসায় একটি এতিমখানাও রয়েছে।

মাদরাসার শিক্ষক বায়েজীদ বাসসকে বলেন, ‘এখানে মাদ্রাসার পাশাপাশি এতিমখানা পরিচালিত হয়। এতিমদের কাছ থেকে কোনো খরচ নেওয়া হয় না। আমাদের এখানে রাফি পড়াশোনা করে এবং তার বিনামূল্যে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা এখানেই করা হয়েছে।'

সালমা আক্তারের মেয়ে মাহি (১০) নরসিংদীর জামিয়া দারুল তাওফিক সালাফিয়া মাদরাসায় পড়ে। মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক আব্দুল মাজিদ শেখ বাসসকে বলেন, ‘আমাদের মাদ্রাসায় প্রায় সাড়ে ৫শ’ ছাত্রছাত্রী রয়েছে। এর মধ্যে ২০ জন এতিমকে আমরা ফ্রি পড়িয়ে থাকি।

তিনি আরও বলে, ‘মাহি এখানে আগে টাকা দিয়ে পড়ত। এখন তার কোনো টাকা দিতে হয় না। মাহি মাদ্রাসার হিফজখানায় পড়ে। তার থাকা খাওয়া সব ফ্রি। মূলত এতিমদের জন্য সবকিছু ফ্রি।’

বিষয়টি নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলা আহ্বায়ক নীরব রায়হান বাসসকে বলেন, ‘সালমা জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা গ্রহণ করেছিলেন। তার শ্বশুর তখন উপস্থিত ছিলেন। পারিবারিক বিভক্তি এখানে বড় ভূমিকা রেখেছে। আরমান দুটি বিয়ে করেছিলেন। সম্ভবত টাকা ভাগ হয়েছে। সালমাকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। তবে এটি এখনও ডিসি অফিসে পৌঁছেনি।’

একাধিকবার অস্বীকার করার পর অবশেষে সালমা বুধবার সকালে টেলিফোনে টাকা পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। 

নীরব রায়হান বলেন, ‘পারিবারিক দ্বন্দ্বই এখানে মূল। সালমা একবার বলেছিলেন, শ্বশুরবাড়ি থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়েছে। পরে আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, এমন কিছু ঘটেনি।’

সবকিছু মিলিয়ে বোঝা যায়, সরকারের পক্ষ থেকে শহীদ আরমান মোল্লার পরিবারের জন্য মোট ৭ লাখ টাকার চেক প্রদান করা হয়েছে, এর মধ্যে ৫ লাখ টাকা দিয়েছে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন এবং ২ লাখ টাকা জেলা পরিষদ। তবে সালমা আক্তার জানিয়েছেন, তিনি হাতে পেয়েছেন মাত্র দেড় লাখ টাকা এবং জামায়াতের দেওয়া ২ লাখ টাকার মধ্যে থেকেও এক লাখ টাকা শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে দিয়েছেন।

বর্তমানে পারিবারিক খরচ নিয়ে সালমা বলেন, ‘আমার বাবা দিনমজুর। আমি এখন তার আয়ের ওপর নির্ভর করে চলছি। যেটুকু টাকা পেয়েছি, তার বড় অংশ স্বামীর ঋণ শোধে খরচ হয়ে গেছে। এখন প্রায় ৫০ হাজার টাকা আছে। আমি কোমরের ব্যথায় কাজকর্ম করতে পারি না। ওষুধের পেছনে প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা খরচ হয়।’

উল্লেখ, সালমা আক্তারের সব বক্তব্য এই প্রতিবেদকের কাছে রেকর্ড আকারে সংরক্ষিত রয়েছে।