শিরোনাম
ঢাকা, ১৪ মে, ২০২৫ (বাসস) : চিকিৎসা শিক্ষার সুশাসনের জন্য সংস্কারের সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন।
স্বাস্থ্য সবার অধিকার উল্লেখ করে ‘স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্কার কমিশন’ গত ৫ মে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
চিকিৎসা শিক্ষার সুশাসনের জন্য সংস্কার বিষয়ে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে চিকিৎসা শিক্ষার গুণগত অবস্থা বর্তমানে উদ্বেগজনক। এই খাতে আন্তর্জাতিক মান অর্জন এবং জনস্বাস্থ্যের প্রয়োজন মেটাতে একটি সমন্বিত, নীতিনির্ভর ও কাঠামোগত সংস্কার অত্যাবশ্যক। চিকিৎসা শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের জন্য একটি সমন্বিত, নীতিনির্ভর ও কাঠামোগত সংস্কার অপরিহার্য্য জনস্বাস্থ্য চাহিদা, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, প্রতিষ্ঠান সক্ষমতা ও ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিক্যাল এডুকেশন-এর গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের কার্যক্রম মূল্যায়ন করতে হবে।’
সুপারিশে বলা হয়, মূল্যায়ন অনুযায়ী পুনর্গঠন করে প্রতিষ্ঠান সংখ্যা ও আসন সংখ্যা পুনর্বিন্যাস করা। সাপ্তাহিক পাঁচদিনের একাডেমিক সপ্তাহ চালু করে শিক্ষার কাঠামো উন্নত করা, ছাত্রদের সম্পৃক্ততা বাড়ানো ও শিক্ষকদের কাজের ভার হ্রাস করা, ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি প্রক্রিয়ায় বাধা দূর করে 'ব্রেইন ড্রেইন' রোধ ও প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। এফসিপিএস এমডি/এমএস কোর্সসমূহে পাঠ্যক্রমে সমন্বয় আনা এবং দেশ-বিদেশে পারস্পরিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করার মাধ্যমে স্নাতকোত্তর চিকিৎসা শিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে।
চিকিৎসা, জনস্বাস্থ্য এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সুশাসনের জন্য সংস্কার বিষয়ে সুপারিশে বলা হয়েছে, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি (বিএমইউ) বর্তমানে গভীর দলীয়করণ, রাজনৈতিক প্রভাব, পক্ষপাতমূলক নিয়োগ এবং দুর্নীতিতে নিমজ্জিত একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে, একে গুরুত্বপূর্ণ উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন, অরাজনৈতিক ও পেশাদার নেতৃত্বাধীন কমিটির মাধ্যমে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার ইতিমধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে প্রতি বছর কোটি-কোটি টাকা ব্যয় করছে। তাতে কাঙ্ক্ষিত গুণগত ফলাফল ও আন্তর্জাতিক মান অর্জনের ক্ষেত্রে এর অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়। তাই প্রশাসনিক, একাডেমিক ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিবর্গকে সম্পৃক্ত করে নতুন কাঠামো তৈরি করতে হবে।
সুপারিশে বলা হয়েছে, ‘নিরপেক্ষ ব্যক্তিবর্গকে সম্পৃক্ত করে নতুন কাঠামো তৈরি করতে হবে। মেডিকেল শিক্ষার কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে মেডিকেল এডুকেশন উইং-কে জনস্বাস্থ্য চাহিদা, গুণগত মান, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ভিত্তিক একটি সক্ষম ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উপযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি, অন্যান্য মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস (বিসিপিএস), প্রাথমিক পর্যায়ে পুরানো আটটি সরকারি মেডিকেল কলেজ এবং পরবর্তীতে সব মেডিকেল কলেজ, বিশেষায়িত হাসপাতালসমূহের জন্য বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশন (বিএইচসি)-এর মেডিকেল এডুকেশন উইং এর অধীনে পৃথক ও স্বশাসিত শাসন কাঠামো গঠন করা। বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি আইনের সংস্কার করে কার্যকর পরিচালন কাঠামো নিশ্চিত করা।’
সুপারিশে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি ও অন্যান্য মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়-সংযুক্ত হাসপাতালসমূহ সরাসরি প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে নিজস্ব বোর্ড অব গভর্ন্যান্স-এর মাধ্যমে পরিচালিত হবে, যাতে নীতিনির্ধারণ ও ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতা নিশ্চিত হয়।’
সুপারিশে আরো বলা হয়েছে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ: বাংলাদেশে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশন-এর পোস্টগ্র্যাজুয়েট মেডিকেল উইং একটি সার্বজনীন বিজ্ঞাপন প্রচার করবে। এই বিজ্ঞাপনে নির্দিষ্ট যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার মানদণ্ড নির্ধারণ করে দেওয়া হবে, যাতে শুধুমাত্র যোগ্য ও অভিজ্ঞ প্রার্থীই আবেদন করতে পারেন। উপাচার্য প্রার্থীর অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে ন্যূনতম ১০ বছর, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ প্রার্থীর সাত বছর অভিজ্ঞতা থাকতে হবে এবং পিএইচডি ডিগ্রিধারী প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। আবেদনকারীর একাডেমিক নেতৃত্ব, গবেষণামূলক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ, উপাচার্য প্রার্থীদের ১০টি, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ সাতটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকাশনা এবং প্রশাসনিক দক্ষতা যাচাই করা হবে। উপাচার্য পদের জন্য অবসরপ্রাপ্ত ব্যাক্তি নিয়োগযোগ্য হবেন না, আবেদনকারীদের অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকতে হবে।’
বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশন গঠিত না হওয়া পর্যন্ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের এই কার্যক্রম সাময়িকভাবে ইউজিসি কর্তৃক পরিচালিত হবে বলে সুপারিশে বলা হয়।
সুপারিশে বলা হয়েছে, ইউজিসি নির্ধারিত যোগ্যতার ভিত্তিতে একটি সার্চ কমিটি গঠন করবে, যারা আবেদনকারীদের মধ্য থেকে যাচাই-বাছাই করে একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রস্তুত করবে। ওই তালিকা বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করা হবে, যিনি সংবিধান অনুযায়ী একজন উপযুক্ত প্রার্থীকে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ প্রদান করবেন। শিক্ষকরা যদি শারীরিক ও মানসিকভাবে সক্ষম থাকেন, তাহলে ৬৭ বছর। পর্যন্ত চাকরি করতে পারবেন। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে স্বচ্ছ, যোগ্যতাভিত্তিক ও দক্ষ নেতৃত্ব নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, যা শিক্ষা, গবেষণা ও প্রশাসনিক কাঠামোর সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনার মুখবন্ধে বলা হয়েছে, স্বাধীনতার পরবর্তী দশকগুলোতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা খাতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবাকে জনমুখী, সহজলভ্য ও সার্বজনীন করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাবের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদনক্রমে ‘স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন’ নামে কমিশন গঠন করে গত ১৮ নভেম্বর গেজেট প্রকাশ করা হয়। জাতীয় অধ্যাপক ও ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি ডা. এ কে আজাদ খানকে কমিশনের প্রধান করা হয়।
স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন ও সুপারিশ প্রণয়নে বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তি, সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী, বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের পরামর্শ ও সহযোগিতা গ্রহণ করেছে।