বাসস
  ২৩ মে ২০২৫, ১৪:৫৪

ঠাকুরগাঁওয়ে বিরূপ আবহাওয়ায় ঝুঁকির মুখে মাঠের ফসল  

ছবি : বাসস

জাকির মোস্তাফিজ মিলু

ঠাকুরগাঁও, ২৩ মে ২০২৫ (বাসস): দেশ জুড়ে এখন চলছে বোরো ধান ও ভুট্টা তোলা, মাড়াই ও শুকানোর  মৌসুম। পাশাপাশি খরিফ মৌসুমের ফসল মাঠে পাকার অপেক্ষায়। কিছু ফসলের বীজতলা তৈরিরও সময় এখন। ঠিক এরকম গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কয়েকদিন ধরে ঠাকুরগাঁও জেলায় অতিবৃষ্টি ও দমকা হাওয়াসহ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে চরম সংকটে পড়েছেন ধান ও ভুট্টা চাষিরা। 

হঠাৎ  ধেয়ে আসা দমকা হাওয়া, মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি আর মেঘলা আবহাওয়ায় মাঠের পর মাঠ ফসল ক্ষতির মুখে। মাঠ ভরা ফসল থাকলেও সময়মতো নিরাপদে ঘরে তুলতে পারবেন কিনা তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষকরা। 

সদর উপজেলার নতুন পাড়া গ্রামের চাষি শাহাবুদ্দিন বলেন, ধান পাকতে শুরু করেছে। আমরা ধান কাটার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু গত তিনদিনের বৃষ্টিতে অনেক গাছ হেলে পড়েছে। কিছু জমিতে পানি জমে থাকায় গাছ পচে যাচ্ছে।

তার মতো হাজারো কৃষক এখন ধান কাটা শুরু করলেও, বৃষ্টির কারণে জমি কাদায় পরিণত হওয়ায় শ্রমিক নামানো যাচ্ছে না। নামলেও তাদের জন্য গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত মজুরি। আবার অনেক কৃষককে দেখা গেছে নিজেরাই কোমর পানিতে নেমে ধান কাটছে।

আকস্মিক দুর্যোগে ভুট্টা চাষিরাও অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। এ বছর ঠাকুরগাঁও সদর, পীরগঞ্জ, রানীশংকৈল ও হরিপুর উপজেলায় ভুট্টা চাষ হয়েছে ব্যাপক হারে। কিন্তু সাম্প্রতিক বৃষ্টির কারণে বেশ কিছু এলাকায় ভুট্টা গাছ লিফ ব্লাইট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। অতিরিক্ত আর্দ্রতায় পাতায় ছোপ ছোপ দাগ পড়ে শুকিয়ে যাচ্ছে।

স্থানীয় চাষি কাজল রহমান বলেন, ‘ভুট্টা গাছ আগা থেকে পাতা পর্যন্ত পচে যাচ্ছে। আগে ফলন দেখে মনে হয়েছিল সব ঠিক আছে। এখন ফলন ঘরে তোলা নিয়েই টেনশনে আছি।’

জেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, অঞ্চলভেদে ক্ষতির ধরন আলাদা। আবহাওয়ার প্রভাবে প্রতিটি উপজেলার কৃষিতে ভিন্ন ভিন্ন রকমের ক্ষতি হয়েছে।

সদর উপজেলার রুহিয়া ইউনিয়নে ধানে পানি জমে গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। পীরগঞ্জ ও রানীশংকৈলে ভুট্টা গাছে লিফ ব্লাইট ও শিকড় পচা রোগ হয়েছে। বালিয়াডাঙ্গীতে বাতাসে ধানগাছ মাটিতে পড়ে গেছে এবং জমিতে পানি জমেছে।

ক্ষতিগ্রস্ত ফসল ঘরে তুলতে এখন পুরুষের পাশাপাশি মাঠে কাজ করছেন নারীরাও। রানীশংকৈলের সরাসরি মাঠ পর্যায়ে গিয়ে দেখা যায়, অনেক নারী কাদামাটিতে নেমে ধান কাটছেন। পরিবারের পাশে দাঁড়াতে তাদের এই অংশগ্রহণ দিন দিন বেড়েই চলেছে।

কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বেশিরভাগ কৃষকই ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে চাষ করেছেন। এবার ফসলের ফলনও ভাল ছিল।

কিন্তু আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগে চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন তারা। আশানুরূপ ফসল ঘরে তুলতে না পারলে ঋণ শোধ করাই কঠিন হয়ে যাবে কৃষকদের জন্য। এদিকে  শ্রমিক সংকট ও বাড়তি মজুরি কৃষকের খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

পীরগঞ্জের কৃষক জয়নাল বলেন, ভুট্টা থেকে অন্তত ৫০ হাজার টাকা আসবে ভেবেছিলাম, এখন তো সেটা স্বপ্ন মনে হচ্ছে।

এ ধরনের আবহাওয়া দীর্ঘস্থায়ী হলে জমি শুকাতে সময় লাগবে। ফলে খরিপ-১ মৌসুমের বীজ বপনের সময়ও পিছিয়ে যেতে পারে। এতে প্রভাব পড়বে সামগ্রিক কৃষি চক্রে। বিশেষ করে যারা ধান কাটার পর সবজি বা অন্যান্য ফসল চাষের পরিকল্পনা করেছিলেন, তারাও এখন অনিশ্চয়তায়। প্রশাসনের আশ্বাস থাকলেও মাঠে এখনো তেমন সহায়তা নেই।

ঠাকুরগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা শামীমা নাজনীন বাসসকে বলেন, ‘আমরা তালিকা করছি। কোথায় কী ক্ষতি হয়েছে তার ভিত্তিতে সহায়তা চাওয়া হবে। কিছু জায়গায় বিশেষ স্কিমের আওতায় ত্রাণ ও বীজ সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।’

তবে কৃষকরা বলছেন, শুধু পরিকল্পনা নয়, এখনই কার্যকর সহায়তা দরকার।

এদিকে বিপর্যয়ের ফলে এরই মধ্যে বাজারে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ভুট্টার দাম বাড়তে শুরু করেছে।  

ভুট্টার কেজি প্রতি দাম বেড়েছে ২৩ টাকা। ধান ও চালের দামেও প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।

ঠাকুরগাঁও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা কৃষিবিজ্ঞানী ড. সরকার মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, আবহাওয়ার এমন আচরণ জলবায়ু পরিবর্তনের স্পষ্ট লক্ষণ। কৃষিকে টেকসই করতে হলে এখন থেকেই প্রশিক্ষণ, আধুনিক চাষাবাদ ও দুর্যোগ প্রস্তুতির দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

মাঠে দাঁড়ানো ধান ও ভুট্টা যেন এখন শুধুই গাছ নয়, এগুলো কৃষকের স্বপ্ন, বিনিয়োগ ও ভবিষ্যৎ। আর সেই স্বপ্ন এখন প্রকৃতির ছোবলে ঝুঁকিতে।

সরকারি সহায়তা এবং সময়োপযোগী ব্যবস্থা ছাড়া এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে না।