শিরোনাম
বিপুল ইসলাম
লালমনিরহাট, ৯ মে ২০২৫ (বাসস): জীবন-জীবিকার তাগিদে মাঠে-ঘাটে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন লালমনিরহাটের নারী শ্রমিকরা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দরিদ্র পরিবারের গৃহবধূ থেকে শুরু করে কিশোরী মেয়েরাও যুক্ত রয়েছেন নানা শ্রমজীবী কর্মকাণ্ডে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করছেন তারা। কিন্তু নারী উন্নয়নের এ সময়েও ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন জেলার শ্রমজীবী নারীরা।
জেলার শ্রমজীবী নারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নারী শ্রমিকদের প্রত্যেকের জীবনেই রয়েছে সংগ্রামের আলাদা গল্প। পুরুষশাসিত সমাজে নিজের ও পরিবারের ভাগ্য বদলাতে পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, কখনোবা আলাদা জোট গঠন করে গ্রামীণ নারী শ্রমিকরা সড়ক মেরামতের মতো কঠিন কাজে অংশ নিচ্ছেন।
তাদের জীবনযুদ্ধের বাস্তব চিত্র উঠে আসে জেলা সদরের স্থানীয় নারী শ্রমিক সখিনা খাতুনের (৪০) কথায়। তিনি জানান, স্বামী সংসার চালাতে না পারায় খেয়ে না খেয়ে কোনোরকমে জীবন চালাতে হয় তাকে। এমন অবস্থায় সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে বিভিন্ন জায়গায় কাজের খোঁজ করেন। এক পর্যায়ে তিনি দিনমজুর হিসেবে রাস্তা মেরামতের কাজ শুরু করেন ।
সখিনা বলেন, ‘রোদ হোক বা বৃষ্টি, পুরুষের সমান পরিশ্রম করি। কিন্তু শুধু নারী হওয়ার কারণে আমার মত অনেক নারী শ্রমিক মজুরি কম পায়। যেখানে একজন পুরুষ শ্রমিক দৈনিক ৪০০-৫০০ টাকা মজুরি পায়, সেখানে আমাদের মজুরি দেওয়া হয় ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত।’
সদরের বড়বাড়ী ইউনিয়নের মরিয়ম খাতুন (৪০) বাসসকে বলেন, ‘নারীদের নিয়ে অনেক দিবস ও সেমিনার হয় শুনি। কিন্তু আমাদের বাস্তবতা হচ্ছে কাজ করলে ভাত জোটে, না করলে উপোস থাকতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত পুরুষদের সাথে সমানভাবে কাজ করলেও তারা পান ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, আর আমাদের নারী শ্রমিকদের দেয়া হয় ২৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫০ টাকা। মজুরি বৈষম্যের কথা মালিকপক্ষকে বললেই মালিকরা কাজ থেকে বাদ দেওয়ার হুমকি দেন।’
একইভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেন নারী শ্রমিক আকলিমা বেগম (৩৫)। তিনি বলেন, ‘মাঠে পুরুষদের মতোই সব কাজ করি। কিন্তু তারা বিশ্রাম নিলেও আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে হয়। এতো কষ্টের পরও ন্যায্য মজুরি পাই না।’
নারী শ্রমিকদের দাবি, বছরে একদিন নয়, প্রতিটি দিন নারীদের সাথে সমান আচরণ করা হোক। তাদের সমান মজুরি দেয়া হোক। তারা মনে করেন, বছরে নিয়ম করে একদিন নারীদের অধিকার আদায়ের কথা বলে তাদের মজুরি, অধিকার কিংবা মর্যাদার বিষয়ে তেমন কোনো পরিবর্তন আসে না। সমান শ্রমের সমান মজুরি এবং ন্যায্য অধিকারের বাস্তবায়ন চান তারা।
সাবেক ইউপি সদস্য ও সমাজকর্মী নীলিমা রানি বাসসকে বলেন, ‘নারী শ্রমিকদের মজুরি কম হওয়ায় তাদের জীবনমান অনেক নিচে। অনেকেই পুষ্টিকর খাবার কিনতে পারে না, ফলে অপুষ্টিতে ভোগেন। এত কষ্ট সহ্য করেও তারা প্রতিবাদ করেন না, কারণ ভয় পান কাজ হারানোর। ফলে বৈষম্য দীর্ঘায়িত হচ্ছে।’
স্থানীয় সমাজকর্মী ও যুব শক্তি সমাজ কল্যাণ সংস্থার সভাপতি জিয়াউর রহমান জিয়া বলেন, ‘মালিকপক্ষই যুগ যুগ ধরে পুরুষ ও নারী শ্রমিকদের মজুরিতে পার্থক্য তৈরি করেছে। অনেক নারী শ্রমিক জানেনই না তাদের অধিকার কী। স্থানীয় সরকার মনিটরিং করলে ধীরে ধীরে এই বৈষম্য দূর হবে বলে তিনি মনে করেন।’
মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, লালমনিরহাটের উপ-পরিচালক লায়লা আক্তার বানু বলেন, ‘সরকার নারী-পুরুষের সমান মজুরির পক্ষে। কিন্তু মালিকপক্ষের কারণে বৈষম্য দেখা যায়। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে আমরা নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলি। সমাজকে সচেতন হতে হবে, যেন নারী শ্রমিকরা তাদের প্রাপ্য সম্মান ও মজুরি পান।’
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এইচ এম রকিব হায়দার বলেন,‘সরকার কখনোই মজুরি বৈষম্য করে না। বরং এই বৈষম্য দূর করতে সরকারের বিভিন্ন কার্যকর কর্মসূচি চালু রয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে নারী শ্রমিকদের সঙ্গে যারা সরাসরি কাজ করেন, বিশেষ করে মালিকপক্ষের সচেতনতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয় সচেতন মহলের তদারকি ও নজরদারি জোরদার করা গেলে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব।’