বাসস
  ৩১ আগস্ট ২০২১, ১৪:১৪

মা টেলিহেলথ সার্ভিস: গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবায় অনন্য উদ্যোগ

॥ আতাউর রহমান ॥
ঢাকা, ৩১ আগস্ট ২০২১ (বাসস) : পৃথিবীব্যাপি যখন করোনা মহামারীর তান্ডব। দেশের সব হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো করোনা রোগীদের সেবায় ব্যস্ত। সেসময় ৬ মাসের গর্ভবতী নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জের আদর্শনগর গ্রামের বাসিন্দা হৃদয়মনি হঠাৎই অসুস্থ বোধ করেন। চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন হয়। তখনই তিনি ‘মা টেলিহেলথ সার্ভিস’ এর মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেন । 
হৃদয়মনি জানান, তার কাশি ও চর্মরোগ ছিল। গর্ভাবস্থায় এই সার্ভিসের মাধ্যমে তিনি দুইবার সেবা নিয়েছেন। সন্তান  প্রসবের পরও তিনি বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছিলেন। তখনও এই সার্ভিসের মাধ্যমে ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ খেয়ে এখন বেশ ভাল আছেন। হৃদয়মনির সন্তান জন্মের কিছু দিন পর থেকে বমী করতো। ডাক্তারের পরামর্শ ও চিকিৎসায় শিশুটিও এখন সুস্থ্য আছে বলে জানান তিনি। 
করোনাকালে প্রতিষ্ঠিত ‘মা টেলিহেলথ সার্ভিস’ এভাবেই শত শত প্রসূতি মায়ের গর্ভকালীন ও প্রসব পরবর্তী সেবাদানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এই সেবা প্রসূতির পরিবারে এনেছে স্বস্তি। শিল্পকারখানার শ্রমিক হৃদয়মনির স্বামী নিজামউদ্দিন করোনাকালের দু:সময়ে কম খরচে টেলি হেলথ থেকে চিকিৎসা সেবা পাওয়ায় প্রতিবেদকের কাছে সন্তষ্টি প্রকাশ করেছেন
এটুআই কার্যালয় সুত্রে জানা যায়, করোনাকালে গর্ভবতী ও মাতৃদুগ্ধদানকারী মা ও শিশুকে নিরবিচ্ছিন্ন স্বাস্থ্যসেবা  পৌঁছে দিতে করোনা মহামারীরর সময়ে মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের ঝুঁকি মোকাবেলায় ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে এটুআই ‘মা টেলিহেলথ সার্ভিস’টি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করে। ইউএনডিপি’র সহায়তায় তথ্য প্রযুক্তি বিভাগ ও এটুআই এর তত্বাবধানে মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তর মা টেলিহেলথ সেন্টার এর মাধ্যমে এ সেবা নিশ্চিত করছে। ২০২০ সালের ১৪ জুন থেকে এ পর্যন্ত এই প্লাটফর্মের মাধ্যমে দেশের নাগরিকদের ৩ লাখ ৭০ হাজারের ও বেশি বার সেবা  দেয়া হয়েছে। 
মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মাতৃত্বকালীন ভাতা বিভাগের কর্মসূচি পরিচালক রুবিনা গনি বাসসকে বলেন, দেশের ৭টি জেলার ৩৯টি উপজেলায় এই কার্যক্রম বেশ সাড়া জাগিয়েছে। তালিকাভুক্ত গর্ভবতী ও মাতৃদৃগ্ধদানকারী মা ও শিশুকে  ডিজিটাল স্বাস্থ্য সেবা দিতে কাজ করছেন ৭৫ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। বর্তমানে দেশের ৩৯ উপজেলার সাধারণ ও গর্ভবতী মায়ের পরিবারের কাছে ‘মা টেলিহেলথ সার্ভিস’ আলোড়ন সৃষ্টিকারী এক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি হিসেবে পরিচিত। বাগেরহাটের চিলতমারী,বরিশালের মেহিন্দীগঞ্জ, সিলেটের গোয়াইনঘাট, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ, বান্দরবানের থানছি, রংপুরের গঙ্গাচড়া, রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলায়  প্রাথমিকভাবে এ কার্যক্রম চালু করা হয়। 
রুবিনা গণি বলেন, মা টেলিহেলথ সেন্টারের হটলাইন: ১০৯ এবং  ফোন: ০৯৬৬৬৮৮৮৮৮৮ নম্বরে ফোন করে করোনা মহামারীর সময়ে কম খরচে দৈনিক প্রায় পাচঁশ’ মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করেন। যা দরিদ্র  ও সাধারণ জনগোষ্ঠীর পারিবারিক স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।  
গোয়াইনঘাটের অষ্টমখন্ড গ্রামের রেহেনা বেগম বলেন, “মা টেলিহেলথ সার্ভিসের মাধ্যমে কম খরচে স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ায় আমাদের এলাকার অনেক গরীব ও সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়েছেন।”
মা টেলিহেলথ সার্ভিস থেকে স্বাস্থ্য বিষয়ক সেবা ও পরামর্শ নিয়ে উপকারভোগী রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার নিলুফা খাতুন। তিনি জানান, জন্মের পর তার শিশু সন্তানের শরীরে ফোস্কা হয়ে সারা শরীর ফুলে যায়। মা টেলিহেলথ সেন্টারে ফোন করে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করে এখন তিনি সুস্থ। নিলুফা  সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতি মাসে ৮০০ টাকা করে মাতৃত্বকালীন ভাতা অনলাইনে নিয়মিত পাচ্ছেন বলে জানান। তার মতো অনেক মা ও শিশু এই স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে উপকৃত হয়েছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। 
নিলুফার মতোই আরেক নতুন মা দোলা আক্তার গত ৬ মাসে দুই বার ওষুধ নিয়ে ভাল হয়েছেন। তিনি ঠান্ডা-জ¦র আর কাশিতে ভুগছিলেন। বরিশালের মেহেদীগঞ্জের চামেলী আক্তার ও মৌসুমী বেগম তাদের বিভিন্ন রোগের জন্য ডাক্তারের কাছে ফোন করে ওষুধ খেয়ে ভাল হয়েছেন বলে টেলিফোনে এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।  
মৌসুমী বেগম জানান, তার দুটি সন্তানই সিজার করে জন্মলাভ করেছে। দি¦তীয় সন্তানের সিজারের পর কাটা স্থানে প্রচন্ড ব্যাথা হতো। পরে মা টেলি হেলথে ফোন  করে চিকিৎসকের পরামর্শ ও ওষধু খেয়ে তিনি এখন পুরোপুরি সুস্থ। মৌসুমী বেগমের সৌদি প্রবাসী স্বামী স্ত্রী ও সন্তানের স্বাস্থ্য সেবায় টেলিহেলথ সার্ভিসের ভূমিকায় সন্তষ্টি প্রকাশ করেছেন। 
কর্মসূচি পরিচালক রুবিনা গনি জানান, মা টেলিহেলথ সার্ভিসের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবার সুফল সারাদেশে সম্প্রসারণের জন্য এটুআই কাজ করে যাচ্ছে। এই সেবা প্রাথমিকভাবে ৭টি জেলায় শুরু করা হলেও পর্যায়ক্রমে সারাদেশে তা সম্প্রসারণ করা হবে। বর্তমানে সারাদেশে ১০ লাখ ৪৫ হাজার মা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় প্রতিমাসে ৮০০ টাকা করে ভাতা পান। প্রত্যেক মা গর্ভবতী হওয়ার দিন থেকে তিন বছর পর্যন্ত এই ভাতা পেয়ে থাকেন। সরকারের তালিকাভুক্ত এসব ভাতার পাশাপাশি  মা টেলি হেলথ সার্ভিসের মাধ্যমে তারা চিকিৎসা সেবা পান। 
তিনি বলেন, সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ আর মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে এটুআই  দেশের মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু হার কমিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। মা ও শিশুর গর্ভকালীন এবং প্রসব পরবর্তী স্বাস্থ্য সেবায় আধুনিক ডিজিটাল প্রদ্ধতি ও মোবাইল ফোনের সেবা দরিদ্র মায়েদের জীবনে এনেছে স্বস্তি ও নিরাপত্তা। এসডিজি বাস্তবায়নে এই উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।