বাসস
  ২৯ মে ২০২৩, ১৬:৫৭

বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত ঝালকাঠির ৪৫০ গ্রাম

॥ আককাস সিকদার ॥
ঝালকাঠি, ২৯  মে, ২০২৩ (বাসস) : আমার বয়স বর্তমানে ৪০ বছর। আমার বাবা ২০ বছর আগে মারা গেছেন। এর বহু বছর আগে আমার দাদা মারা যায়। আমার বাপ দাদা কেউ বাড়িতে বিদ্যুতের আলো দেখে যেতে পারেননি। সারা জীবন তাদের কেটেছে কুপি কিংবা হেরিকেনের আলোতে। আমার জীবনের ৩৯ বছর কেটেছে হেরিকেন ও কুপি বাতির আলোয়। বর্তমান সরকারের আমলে গত বছর ২০২২ সালের প্রথম দিকে আমাদের বাড়িতে বিদ্যুত এসেছে। বাপ দাদা এবং আমার জীবনের বিরাট অংশ বিদ্যুতের আলা ছাড়া কাটলেও এখন মনে কোন দুঃখ নেই, কারণ আমার সন্তানরা বিদ্যুতের আলোতে লেখা পড়া করতে পারবে। সন্তানদের জীবন বিদ্যুতের আলায় আলাকিত হবে। এ যে কি আনন্দের বলে বোঝানো যাবে না। কথাগুলো বলছিলেন শ্রমিক মো. আব্দুর রাজ্জাক হাওলাদার (৪০)। আব্দুর রাজ্জাক হাওলাদার আরও বলেন, বিদ্যুতের লাইন আনতে বাড়তি কোন টাকা পয়সা খরচ হয়নি। ৪ শত টাকা জামানত, ১৩০০ টাকা মিটার এবং ২১০০ টাকার মালামাল কিনে বিদ্যুতের সংযোগ পাওয়া গেছে আবেদনের সাত দিনের মধ্যে। বর্তমানে আমাদের গ্রামে এমন কোন বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে না যে বাড়িতে বিদ্যুত নেই।
শুধু ঝালকাঠি সদরের দিয়াকুল বা ভাওতিতা গ্রাম নয় বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত এখন দেশের প্রতিটি প্রান্তর। খাল-বিল নদীনালা এবং বিস্তীর্ন মাঠ পেরিয়ে উপকূলীয় অঞ্চল ঝালকাঠির চার উপজেলা ও ৩২ ইউনিয়নের ৪৫০টি গ্রামে লেগেছে বিদ্যুতের ছোঁয়া। আলোকিত হয়েছে দুর্গম উপকূলীয় জনপদ ও বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। আধাঁর কেটে আলোর পথে যাত্রা শুরু করছে গ্রামের মানুষ। জেলার ৬ লাখ ৮২ হাজার মানুষ এখন বিদ্যুতের সুবিধা পাচ্ছে। ঝালকাঠি সদর উপজেলার কেওড়া গ্রামের আবাসন প্রকল্পে সর্বশেষ ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে বিদ্যুত সংযোগ দিয়েছে ঝালকাঠির ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো)। 
এই আবাস প্রকল্পে ২২ টি পরিবার বসবাস করে। প্রকল্পের বাসিন্দা দিন মজুর রবিউল হাওলাদার বলেন, বিদ্যুত সংযোগ পেয়ে আমরা খুবই আনন্দিত। অর্থের অভাবে আমি লেখা পড়া করতে পারিনি বিদ্যুতের আলোও দেখিনি। আমার বড় ছেলে দশম শ্রেণিতে পড়ে, মেয়ে ৪র্থ শ্রেণিতে। ওরা বিদ্যুতের আলোতে পড়া লেখা করছে, এটা দেখেই আমরা ভীষণ খুশি ।
ঝালকাঠি জেলা শহর থেকে প্রায় ৫০ কিমি দূরের গ্রাম কাঠালিয়া উপজেলার নেয়ামতপুরা গ্রামের মানুষ কল্পনাও করেনি তাদের ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো জ¦লবে। গত ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর কাঁঠালিয়া উপজেলাকে শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় ঘোষণা করা হয়। ঘোষণার কয়েকমাস আগেই কাঁঠালিয়া উপজেলার বেশিরভাগ গ্রামে বিদ্যুতের লাইন টানা হয়। সর্বশেষ সংযোগ দেয়া হয় উপজেলার নেয়ামত পুর গ্রামে। বিদ্যুতের আলোর হাতছানিতে আনন্দিত নেয়ামতপুরার এলাকাবাসী। বিদ্যুৎ আসায় এখানকার শিক্ষাব্যবস্থা ও অর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নসহ প্রযুক্তি ব্যবহারে এসেছে সুফল। 
নেয়ামতপুরা গ্রামের বাসিন্দা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী অমল দাস (৬০) বলেন, আমাদের গ্রামে বা ঘরে বিদ্যুতের আলো জ¦লবে তা কল্পনাও করিনি। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ আসায় জীবনযাত্রার মানে পরিবর্তন আসবে বলে আশা রাখি। পাটিকেলঘাটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মমিন উদ্দিন পলাশ, বলেন দীর্ঘ বছর প্রতীক্ষার পর আমাদের গ্রামে বিদ্যুত এসেছে। এটা আমাকে সত্যিই আননন্দিত করেছে। কারণ, শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে মাল্টিমিডিয়া ক্লাশের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু বিদ্যুত না থাকায় আমরা দীর্ঘদিন সমস্যায় ভুগেছি। আজ আমরা বিদ্যুত পেয়ে অনেক খুশি। ছাত্র ছাত্রীরা অনেক উপকৃত হবে ।
 কাঁঠালিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মিজানুর রহমান বলেন, বিগত ১৪ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বিদ্যুতখাতের অভাবনীয় সাফল্যে এসেছে। বিদ্যুত সংযোগ পাওয়ায় খুশি এলাকার বাসিন্দারা। গ্রামের সবুজ গাছ পালার মধ্যে সুশৃঙ্খল বিদ্যুতের নতুন খুঁটিগুলো শোভা ছড়াচ্ছে। আমার উপজেলার সব গ্রামে বিদ্যুত পৌঁছেছে। যারা নতুন বাড়ি ঘর তুলছে তারা এখন বিদ্যুত সংযোগ নিচ্ছে। যদিও পল্লী বিদ্যুত সমিতি বিদ্যুত সংযোগ দেয়ার যাবতীয় কাজ করে থাকে। তারপরও যদি কোন বাসিন্দা আবেদন করে সঠিক সময় সংযোগ না পায় সেক্ষেত্রে আমি ব্যক্তিগতভাবে খোঁজ খবর নিয়ে থাকি।
ঝালকাঠি ওজোপাডিকোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুর রহিম জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২২ সালের ২১ মার্চ সমগ্র দেশকে শতভাগ বিদ্যুতের আওতাভুক্ত ঘোষণা করেছেন। কিন্তু, এ ঘোষণার আগেই ঝালকাঠি বিদ্যুতের শতভাগ আওতায় আসে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে ঝালকাঠি বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা ছিল ৬০ হাজার ৬৮১ জন। আর বর্তমানে ঝালকাঠি জেলায় গ্রাহক সংখ্যা ১ লাখ ৯১ হাজার ৭০৬ জন। 
আব্দুর রহিম আরও জানান, এখন যাদের নতুন সংযোগ প্রয়োজন হচ্ছে তারা আবেদন করার সাতদিনের মধ্যে মাত্র ৪ শ’ টাকা জামানত জমা দিয়ে সংযোগ পাচ্ছে। কোন কোন সময় ৩ থেকে ৫ দিনের মধ্যেও নতুন সংযোগ দেয়া হচ্ছে। 
ঝালকাঠি পল্লী বিদ্যুত সমিতির জেলারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী মো. ইমদাদুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার খাত হিসেবে আমরা পল্লী বিদ্যুতের কর্মীরা প্রতিটি মানুষের বাড়িতে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার জন্য করে যাচ্ছি। ঝালকাঠির চার উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা পল্লী বিদ্যুতের আওতায় এবং গত ১৪ বছরে এখানে গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৪ গুন।
ঝালকাঠির বসিন্দা ফারাহ্ গুল নিঝুম বলেন, প্রধানমন্ত্রী ২০০৯ সালে নির্বাচিত হয়েই প্রতিটি মানুষকে বিদ্যুতের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি ঘোষণা দিয়েই থেমে যাননি। ২০২২ সালের মার্চ মাসে ঝালকাঠিসহ সমগ্র দেশকে বিদ্যুতের আওতায় আনতে সক্ষম হন এবং আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন । দেশের প্রতিটি গ্রামকে বিদ্যুতের আলোয় আালোকিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ধন্যবাদ পেতেই পারেন।
 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়