বাসস
  ০২ আগস্ট ২০২১, ১৫:০৬
আপডেট  : ০২ আগস্ট ২০২১, ১৭:২২

ডিজিটাল ম্যাজিকে বদলে যাচ্ছে ভোলা

॥ হাসনাইন আহমেদ মুন্না ॥
ভোলা, ২ আগস্ট, ২০২১ (বাসস) : বর্তমান সরকারের ডিজিটাল ব্যবস্থাপনায় বদলে যাচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ দ্বীপ জেলা ভোলা। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেবা কেন্দ্র, ই-মিউটেশন সার্ভিস, ই-নথি কার্যক্রম, ই-টেন্ডার, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, সরকারি ইন্টারনেট সংযোগ, জাতীয় তথ্য বাতায়ন, ই-কোর্টসহ নানা উদ্যোগে সহজ করে দিচ্ছে স্থানীয়দের জীবনমান। সমাজ সেবা অফিস, পল্লী বিদ্যুৎ, খাদ্য অফিস, পাসপোর্ট অফিসসহ বেশ কয়েকটি কার্যালয় ই-নথি কার্যক্রমে এগিয়ে রয়েছে। এছাড়া জেলার প্রায় সকল সরকারি, বেসরকারি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সিসি ক্যামেরার আওতায় এসেছে। ফলে যে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা সহজেই ক্যামেরায় ধরা পড়ছে। ডিজটাল সেবার ফলে মানুষের ভোগান্তি কমছে। ভোলাবাসী ঘরে বসে খুব সহজে বিভিন্ন সেবা পাচ্ছেন। ফলে মানুষের সময় ও অর্থ দুটোর সাশ্রয় হচ্ছে। নিশ্চিত হচ্ছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলার সরকারি দপ্তরের শতভাগ কার্যক্রম ই-নথির মাধ্যমে করা হচ্ছে। সমস্ত হার্ড ও সফট ফাইলের আদান প্রদান হচ্ছে কম্পউিটারের মাধ্যমে। জেলার ২৪০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারিকে ই-নথিতে বিশেষ প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। এখন আর সেবা গ্রহণের জন্য জনসাধারণকে এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে ঘুরতে হয়না। সুযোগ থাকছেনা কোন ধরনের দুর্নীতি বা অন্যায়ের। সব কিছু একটা নিয়মের মধ্যে পরিচালিত হচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, ইনফো সরকার প্রকল্পের আওতায় ফেইজ-২ এর মাধ্যমে জেলার সকল পর্যায়ের সরকারি দপ্তরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ  দেয়া হয়েছে। একইসাথে ওইসব দপ্তরে ভিডিও কনফারেন্সের বিভিন্ন ডিভাইস ব্যবহৃত হচ্ছে। এই সেবার আওতায় ফেইজ-৩ এর মাধ্যমে জেলার ১৭টি ইউনিয়নে ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করা হয়েছে। ফলে জেলার গ্রামীণ এলাকায় সহজলভ্য হয়েছে ইন্টারনেট ব্যবস্থা। মানুষ সহজেই বিশ্বের যে কোন প্রান্তের খবর পাচ্ছে। জানা গেছে, পরবর্তী পর্যায়ে কানেকটেড বাংলাদেশ প্রকল্পের মাধ্যমে ২৯ টি ইউনিয়নে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া হবে। এখান থেকে ব্যবসার উদ্দেশ্যে ইন্টারনেট সংযোগ নেয়া যাবে।
এছাড়া জেলায় শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব চালু রয়েছে ৪৯ টি,  যা মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল ও মাদ্রাসা এবং উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ ও মাদ্রাসায় দেয়া হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও কিছু প্রকল্পের মাধ্যমে আরো কিছু ল্যাব দেওয়া হয়েছে। এসব ল্যাব ইতোমধ্যেই বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে । শুধু শিক্ষার্থীরাই এসব ল্যাবে শিখবে তা নয়, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রশিক্ষণের জন্যও এসব ল্যাব ব্যবহার করতে পারে। মূলতঃ ল্যাবে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেসনসহ বিভিন্ন বিষয়ে ধারনা দেওয়া হয়। এ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে আরো ৭০ টি ল্যাব স্থাপন করা হবে। 
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) শংকর কুমার বিশ্বাস বাসস’কে জানান, জেলায় বর্তমানে ৮৩টি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) রয়েছে। এখান থেকে প্রতিনিয়তই জনসাধারণ সেবা পাচ্ছেন। তিনি জানান, ইউএনও অফিস ও এসি ল্যান্ড অফিসগুলোতে ই-মিউটেশন এর কাজ করা হচ্ছে। রেকর্ড রুম থেকে একজন নাগরিক ঘরে বসেই জমির পর্চা পাচ্ছেন। জেলা প্রশাসনের ই-নথি কার্যক্রম অনেক আগেই শুরু হয়েছে। ই-নথি ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের মধ্যে ভোলা প্রথম সারিতে রয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের প্রশিক্ষণের আওতায় এনে তাদের আরো দক্ষ করে গড়ে তোলা।
তিনি বলেন, ই-টেন্ডারের মাধ্যমে শতভাগ সচ্ছতা বজায় রেখে সরকারের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। টেন্ডারবাজীর আর কোন সুযোগ থাকছেনা। আউট সোর্সিং এর মাধ্যমে কাজ করা হচ্ছে। এর ফলে ঘরে বসেই আইটি এক্সপার্টরা  ব্রাউজিং করে বিভিন্ন মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছে। তারা যে আয় করছেন তা আমাদের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখবে এবং বেকার সমস্যার সমাধানে সহায়ক হবে বলে তিনি মনে করেন।
ভোলা সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভুমি) মো: আবু আব্দুল্লাহ খান বাসস’কে জানান, ই-মিউটেশন সম্পূর্ণ হয়রানিমুক্ত একটি সেবা পদ্ধতি। এখানকার মানুষ অনেক সচেতন। তারা এই সেবা নিতে বেশ আগ্রহী। চলতি অর্থবছরে সদর উপজেলায় প্রায় ৫ হাজার মানুষ ই-মিউটেশন সেবার আওতায় এসেছে। তারপরেও  গ্রামের অনেক সাধারণ মানুষের এই সেবা সম্পর্কে ধারনা নেই। তাদের সচেতন করার জন্য হেল্প ডেক্স চালু রয়েছে। সেখানে তাদের এ বিষয়ে সব ধরনের সহায়তা করা হচ্ছে। একইসাথে ব্যানার ফেস্টুনের মাধ্যমে ই-মিউটেশন সম্পর্কে প্রচারণা চলছে।
সদর উপজেলার মেঘনা পাড়ের ইউনিয়ন ধনীয়া। এই ইউডিসি’র  উদ্যেক্তা মো: ইব্রাহিম খলিল। তিনি প্রায় ১১ বছর ধরে কাজ করছেন এখানে। তিনি জানান, ইউডিসি থেকে সাধারণত তৃণমূল পর্যায়ের মানুষই  বেশি সেবা নিয়ে থাকেন। তাদের এখন আর শহরে যাওয়ার প্রয়োজন হয়না। এখানে স্বল্পমূল্যে পাসপোর্ট, প্রশিক্ষণ, ই-মেইল, কম্পোজ, ছবি থেকে ছবি নেয়া, ব্যাংক একাউন্ট খোলা, বিকাশের টাকা উত্তোলন, চিঠি আদান প্রদান, ই কমার্স সাইড, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনসহ শতাধিক সেবা দেয়া হয়। এখানেই ই-নামজারীর সুবিধা পাওয়া যায় তাই মানুষকে আর কষ্ট করে ভুমি অফিসে যেতে হয়না। এখানে দৈনিক গড়ে ৫০ থেকে ১০০ মানুষ সেবা নিয়ে থাকেন বলে জানান তিনি। কখোনো কখোনো প্রচুর চাপ সামলাতে হয়। তাই তিনি দুজন সহকারী রেখেছেন। একইসাথে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সকল কার্যক্রম এখান থেকেই পরিচালিত হয়। এই ডিজিটাল সেবাকেন্দ্র থেকে মাসে তার ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা আয় হয়। গত এক বছরে এখান থেকে ৪৫ হাজার মানুষ সেবা নিয়েছেন এবং আয় হয়েছে ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
মেঘনা তীরের কোরার হাট এলাকার বাসিন্দা কলেজ ছাত্র জোবায়ের হাসান, রাকিবুল ইসলাম ও সাহেদ আলী ইউনিয়ন ডিজিটাল সেবা কেন্দ্র থেকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তারা বলেন, অনলাইন ভিত্তিক যে কোন বিষয়ে আমাদের শহরে যেতে হয়না। এখানে সব বিষয় সম্পর্কে জানতে পারি।
জেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) আবুল বাশার জানান, আমাদের পল্লী বিদ্যুতের সকল কার্যক্রম অনলাইন ভিত্তিক পরিচালিত হচ্ছে। গ্রাহকের নতুন লাইন সংযোগের ক্ষেত্রে অনলাইনের মাধ্যমে আবেদন ও অনলাইনে টাকা জমা নেওয়া হয়। বিদ্যুৎ বিল বিকাশ ও রকেটে নেওয়া হয়। এছাড়া ইউডিসি’র মাধ্যমেও গ্রাহকরা বিদ্যুৎ বিল জমা দিতে পারেন। এতে করে জনগণ ঝামেলামুক্তভাবে তাদের কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছেন।
উপজেলা সদরের দক্ষিণ দিঘলদী ইউনিয়নের বালিয়া গ্রামের বাসিন্দা মোস্তাফিজুর সরদার বলেন, আগে পল্লী বিদ্যুতের বিল দেওয়ার জন্য রিক্সা করে অফিসে যাওয়া লাগত। এখন ঘরে বসে মোবাইলের মাধ্যমেই বিল পরিশোধ করা যায়। এতে সময় ও অর্থ দুটোই সাশ্রয় হয়।
এদিকে করোনার এই সংকটে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল পাচ্ছে জেলা ভিত্তিক অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম। করোনার দীর্ঘ সময় ধরে জেলার সকল পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা অন-লাইনের মাধ্যমে তাদের পাঠ গ্রহণ করছেন। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নিখিল চন্দ্র হালদার বলেন, দেশ যদি ডিজিটাল না হতো, তাহলে করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতো আমাদের শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সেটা হয়নি। অনলাইনে দীর্ঘ সময় ধরে তারা বাড়িতেই শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। 
তিনি জানান, বর্তমানে জেলার শিক্ষার্থীরা তাদের উপবৃত্তির টাকাও অনলাইনের মাধ্যমে পাচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে জেলার প্রায় ৪৫ ভাগ শিক্ষকের অনলাইন ভিত্তিক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। পর্যায়ক্রমে শতভাগ শিক্ষককে এর আওতায় আনা হবে। তাদের সকল দাপ্তরিক কার্যক্রম ডিজিটাল ব্যবস্থায় পরিচালিত হয় বলে জানান তিনি।
ভোলা প্রেসক্লাব সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এম. হাবিবুর রহমান বলেন, আজকের বাংলাদেশ ডিজিটালাইজড হওয়ায় সবচে বেশি সুফল ভোগ করছে সাংবাদিকরা। ৭০ এর দশকে আমরা প্রেস টেলিগ্রাম (টরে টক্কা ট) এর মাধ্যমে সংবাদ পাঠাতাম। তাও লাইন ভালো ছিলোনা। দীর্ঘ সময় চেষ্টা করেও সংবাদটি পাঠাতে পারতাম না। বিশেষ ক্ষেত্রে ওয়্যারলেস ব্যবহার করতাম। আর বর্তমানে খুব সহজেই মুহুর্তের মধ্যে বিশ্বের যে কোন প্রান্তে মেইলে সংবাদ পাঠানো যায়। যা মফস্বল সাংবাদিকদের কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছে। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতাসহ সরকারের বিভিন্ন ভাতা অনলাইনের মাধ্যমে সরাসরি এ্যাকাউন্টে এসে জমা হয়। তাই ভাতা উত্তোলনের ক্ষেত্রেও ভোগান্তি কমে গিয়েছে।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুজিত হওলাদার বাসস’কে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদের সকল কার্যক্রম অনলাইন ভিত্তিক করার এবং জনগণকে সকল সরকারি সেবা যাতে অতি দ্রুততার সাথে হয়রানিমুক্তভাবে দেয়ার লক্ষ্যেই ডিজিটাল ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিলো। মানুষ আগে এটা নিয়ে কথা বলত। কিন্তু এটা যে আমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা করোনাকালে আমরা বুঝতে পারছি। করোনা মহামারী কালে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে সকল সভা-সেমিনার-ই-নথি কার্যক্রমসহ বিভিন্নভাবে সাধারণ মানুষকে সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে। ভোলায় এই সেবা কার্যক্রম অনেক উন্নত হয়েছে। ইতোমধ্যে ভোলার মানুষ এর সুফল পাচ্ছেন। মানুষের জীবন মানেরও অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে দূর দূরান্ত থেকে মানুষকে সেবা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আসতে হতো। এখন ই-মেইলের মাধ্যমে তারা তাদের আবেদন, অভিযোগসহ সুযোগ সুবিধার কথা বলতে পারছেন। আমরা এখান থেকেই সমস্যার সমাধান দিতে পারছি। এতে মানুষের খরচ, সময় ও হয়রানি অনেকটাই কমে গিয়েছে।
 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়