বাসস
  ২০ জুন ২০২২, ১৭:৪১

দূরদর্শী নেতৃত্বের সাফল্য গাঁথা ধ্বনিত হচ্ছে পথে-প্রান্তরে

॥ ইমাম উদ্দিন মুক্তা ॥
ময়মনসিংহ, ২০ জুন ২০২২(বাসস) : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুরদর্শী চিন্তাচেতনার কেন্দ্রবিন্দুই হচ্ছে- সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়ন। নিরন্তর স্বপ্ন দেখেন তিনি সাধারন মানুষের জীবন মান উন্নয়নের। “আমার বাড়ি আমার খামার”- তাঁর এক অনন্য স্বপ্নের প্রকল্প। 
এটি ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ নামেই সমধিক পরিচিত। প্রতিটি মানুষকে স্বাবলম্বী হওয়ার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার এই প্রকল্প আজ বাঁচার পথ দেখিয়েছে দেশবাসীকে। এই প্রকল্পের সাফল্যে দরিদ্র-হতদরিদ্রদের স্বাবল¤ি¦তার বার্তা ধ্বণিত হচ্ছে  গ্রাম বাংলার পথে-প্রান্তরে।   
ময়মনসিংহ জেলায় এই প্রকল্পের ্আওতায় সমিতির সংখ্যা আজ ১০ হাজার ৫৬ টি। আর সদস্য সংখ্যা হচ্ছে- ৪ লাখ ৭০ হাজার ৫৫৬। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে এই প্রকল্প । ব্যাংকের ঋণ সহায়তা, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে হতদরিদ্র মানুষগুলো একাধারে যেমন আত্ম নির্ভরশীল হচ্ছেন, তেমনি অনেকেই হয়ে উঠছেন সফল ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। 
প্রকল্পের ময়মনসিংহ জেলা (আঞ্চলিক) কার্যালয়ের সিনিয়র অফিসার মোঃ হুমায়ুন কবির জানান, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর ১০টি বিশেষ উদ্যোগের মধ্যে প্রথম। ২০০৯ সাল থেকে এই প্রকল্পটির কার্যক্রম শুরু হয়। এ পর্যন্ত প্রকল্পের আওতায় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের মাধ্যমে ১২৮৩ কোটি ৪২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে।
এই প্রকল্পের ঋণ সহায়তায় যারা নিজেদের ভাগ্য ফিরিয়ে সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাদেরই একজন হচ্ছেন সেলিনা আক্তার। অল্প বয়সে তার বিয়ে হয়। স্বামী আব্দুর রশিদ সামান্য বেতনে চাকরি করতেন স্থানীয় একটি ক্লিনিকে এক্সরে অপারেটর হিসেবে। স্বামীর বেতনের সামান্য টাকায় সংসার চালানো ছিল তাদের খুবই কষ্টকর। অল্প বয়সে বিয়ে হলেও তিনি তার লেখাপড়া চালিয়ে যান। সংসার চালানোই যেখানে নিদারুন কষ্টকর, সেখানে লেখাপড়ার খরচ চালানো অসম্ভব। অনটনের ভেতরেও তিনি ¯œাতক পর্যন্ত পড়ালেখা চালিয়ে গেছেন। তারপর একটি চাকুরির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন । 
২০০৭ সালে ৭জন দুস্থ ও গরীব মহিলাদের নিয়ে  সেলিনা জীবনের পালাবদলের যাত্রা শুরু করেন ।  মাটির তৈরী ব্যাংকে জমাকৃত ৪ হাজার টাকার সাথে স্বামীর দেওয়া এক হাজার টাকা মিলিয়ে একটি সেলাই মেশিন কেনেন। যুব উন্নয়ন থেকে নেন সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ। নিজ ঘরে বসেই শুরু করেন সেলাইয়ের কাজ। সঙ্গের ৭ দুঃস্থ মহিলাকে নিয়ে জামাকাপড় তৈরী করে, দোকানে দোকানে বিক্রি শুরু করেন তিনি। এভাবেই তার আয় বাড়তে থাকে। 
২০১২ সালে ইচ্ছে ঘুড়ি নামে কারুপণ্যের একটি দোকান খোলেন বাসার সামনে। এতে বিভিন্ন ধরনের কারুপন্য, ছেলেমেয়েদের পোশাক-আশাক তৈরী করে বিক্রি করে ভালই আয় হতে থাকে। এরপর সুযোগ আসে মুক্তাগাছা উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে উন্নয়ন মেলায় অংশগ্রহণের। সেখানে তৈরী পোশাকের একটি স্টল নেন। পাশেই ছিল একটি বাড়ি একটি খামার বা পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের স্টল। সেখান থেকে হতদরিদ্রদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিভিন্ন সুযোগসুবিধা ও ঋণ সহায়তার কথা জানতে পেরে তিনি আরো উদ্বুদ্ধ হন। এলাকার দুস্থ মহিলাদের নিয়ে ঈশ্বর গ্রাম নন্দীবাড়ি মহিলা সমিতি গঠনের মাধ্যমে নতুন উদ্যোগে যাত্রা শুরু করেন। তখন সমিতির সদস্য সংখ্যা ছিল ৪৩জন।  পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক থেকে প্রথমেই তিনি ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। সময়মত তা পরিশোধ করে পরে আরো ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে বড় আকারে পোশাক তৈরীসহ কারুপণ্যের কাজ শুরু করেন। 
নিজেদের তৈরী পোশাক বিভিন্ন নামী দামী দোকানে সরবরাহ করে বাড়তি আয়ের সুযোগ তৈরি হয।   নিজের ব্যবসা প্রসারের সাথে সাথে বাড়তি জনবলের প্রয়োজন দেখা দেয়। তিনি সমিতির সদস্যভুক্ত দুঃস্থ নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। এদেরকে প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা বাড়তি রোজগারের ব্যবস্থা করে দেন। এতে তার সব খরচ বাদে মাসে গড়ে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। তিনি এখন ভালভাবেই সংসার চালাচ্ছেন। স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে জীবনে। স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে চলছে সংসার। ভবিষ্যতে সরকারী সুযোগসুবিধা আরো বেশি পেলে ছোট আকারে পোশাক তৈরির কারখানা চালু করার ইচ্ছা রয়েছে বলে তিনি জানান। 
তিনি একজন সফল ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হওয়ায় জাতীয়ভাবে সফল আত্মকর্মী পুরস্কার লাভ করেন। প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরষ্কার গ্রহন করেছেন। তাকে দেখে এখন এলাকার ছবি রানী বিশ্বাস, রিপা আক্তার, নুরজাহান, সুরমা আক্তারসহ অনেকেই উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। তারাও এখন সংসার ভাল চালাচ্ছেন।
এই প্রকল্পের আরেক সুবিধাভোগি জীবন সংগ্রামে জয়ী রুবেল মিয়া। মুক্তাগাছা উপজেলার মুজাটি গ্রামের আমার বাড়ি আমার খামার সমিতির একজন সদস্য। এসএসসি পরীক্ষায় পাস করার পর আর্থিক অনটনের কারণে পড়ালেখা চালাতে পারেননি। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে তার ভাল লাগেনি। তার দুটি সন্তান। বাবার সংসারে যেন বোঝা হয়ে উঠেন তিনি। আয় রোজগার না থাকায় সব সময় দুঃচিন্তায় কাটতো তার দিন। অবশেষে তিনি একটি পাওয়ার টিলার কেনেন। সেটি দিয়ে অন্যের জমিতে চাষ করে যে টাকা পান তা দিয়ে কোন মত সংসার চালাতে থাকেন। কিন্তু এভাবে সংসার চালানো সম্ভব নয় ভেবে তিনি একটি বকনা বাছুর কিনেন। বাবার কাছ থেকে পাওয়া আরেকটি বাছুর গরু নিয়ে পরিচর্যা শুরু করেন। 
রুবেল জানান, বিটিভিতে প্রতিদিন একটি বাড়ি একটি খামার নিয়ে অনুষ্ঠান প্রচার হতো।  কিভাবে প্রকল্পের মাধ্যমে গবাদি পশু পালন করে অনেকেই স্বাবলম্বি হচ্ছেন, তা দেখে তিনি উদ্বুদ্ধ হন। এক পর্যায়ে নিজের বাছুর গরু দুটি এক লাখ টাকায় বিক্রি করে দুটি ফ্রিজিয়ান জাতের বকনা বাছুর কিনেন। সেই বাছুর গরু সঠিক প্রক্রিয়ায় লালন পালন করে, এখন তিনি ৯টি গরুর খামারী। যার বাজার মূল্য প্রায় ২৭ লক্ষ টাকা বলে তিনি জানান। এর মধ্যে ৬টি গাভী, দুটি বকনা বাছুর ও একটি ষাড় বাছুর রয়েছে। সেখানে তিনটি গাভী প্রতিদিন ৬০ লিটার দুধ দিচ্ছে। এই দুধ তিনি মুক্তাগাছার মন্ডার দোকান, আর্মড ব্যালিয়ন ক্যাম্পে বিক্রি করে প্রতিদিন ৩ হাজার টাকা আয় করেন। সমিতির সদস্য হয়ে তিনি পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক থেকে প্রথমে ১০ হাজার টাকা , পরে ২০ হাজার টাকা এবং পরবর্তীতে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেন রুবেল। এ ঋণের টাকা প্রয়োজনীয় মূহুর্তে খামারের কাজে লাগিয়ে খামার সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছেন বলেন তিনি জানান। দুধ বিক্রির টাকাতে সংসার চালানোর পাশাপশি সন্তানের লেখা পড়া চলছে ভাল মত। এলাকায় এখন তিনি এক সফল খামারী হিসেবে পরিচিত।
অপরদিকে দুল্লা ইউনিয়নের ধানুকা গ্রামের ‘ধানুকা আমার বাড়ি আমার খামার সমিতি’র সদস্য জুনিয়া ইয়াসমিন অপর একজন সফল উদ্যোক্তা। গাভী পালনের মাধ্যমে তিনি অতিদরিদ্র থেকে এখন একজন আর্থিক স্বাবলম্বী নারী। একসময় তিনি সামান্য রাজমিস্ত্রি শ্রমিক স্বামী সংসার নিয়ে অজপাড়া গাঁয়ের ছোট্ট একটি মাটির ঘরে খেয়ে না থেকে দিন কাটাতেন। এই প্রকল্পের ঋণ নিয়ে আত্মকর্মসংস্থানী হয়ে তিনি সংসার  জীবনে এখন সুখী। মাটির ঘর বদলে এখন আধাপাকা ঘর করেছেন। প্রতিদিন তিনি এখন নগন টাকা গুনেন। ঘরের সাথে লাগোয়া গরুর খামার তার। তার এ পরিবর্তন ঘটেছে মাত্র ১০ বছরে।
একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের মুক্তাগাছা উপজেলা সমন্বয়কারী মাহমুদুল হাসান জানান, তারা সরকারের এই বিশেষ প্রকল্পটি মাঠ পর্যায়ে যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হতে পারে, সে জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকেন। গ্রামের দুস্থ জনগোষ্ঠিকে সমিতিভুক্ত করে তাদের ঋণ দানের পাশাপাশি প্রত্যেকটি কাজে সঠিক পরামর্শ দিয়ে, পাশে থেকে তাদের সার্বিক সহযোগিতা করেন। তাদের এসব প্রচেষ্টার সাফল্য প্রসঙ্গে তিনি জানান, মুক্তাগাছা উপজেলায় সমিতির সদস্য সংখ্যা এখন  ১১ হাজার ৮১১ জন, সঞ্চয়  ৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা, ঋণ গ্রহিতার সংখ্যা ৭ হাজার ৭৮৮জন। ক্রমপুঞ্জিভূত বিনিয়োগ ৩৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা এবং আদায় ২৮ কোটি ৯লাখ টাকা।