বাসস
  ৩০ মার্চ ২০২২, ১৬:১৪

চট্টগ্রামে প্রথম গণহত্যা সংঘটিত হয় একাত্তরের ৩১ মার্চ 

॥ দেবদুলাল ভৌমিক ॥
চট্টগ্রাম, ৩০ মার্চ, ২০২২ (বাসস) : চট্টগ্রামের প্রথম গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল ১৯৭১’র ৩১ মার্চ। এ দিনে চট্টগ্রাম নগরে হালিশহরের মধ্যম নাথপাড়ায় পাকবাহিনীর সহযোগিতায় স্থানীয় বিহারিরা এ হত্যাযজ্ঞ চালায়। ওইদিন মাত্র কয়েক ঘন্টায় কুড়াল, কিরিচ আর রামদা দিয়ে কুপিয়ে ৪০ জন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল (ইপিআর) সদস্য এবং ৩৯ জন নাথপাড়াবাসীসহ ৭৯ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
সাংবাদিক শাখাওয়াত হোসেন মজনুর লেখা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা গ্রন্থ ‘মধ্যম নাথপাড়া বধ্যভূমি’ ও শহীদ অনিল বিহারী নাথ, দুলাল নাথ ও বাদল নাথের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আলাপ করে তাদের বর্ণনা থেকে হত্যাযজ্ঞের এ লোমহর্ষক তথ্য পাওয়া যায়। 
শহীদ অনিল বিহারী নাথের ছেলে পিযুষ নাথ বাসসকে জানান, ’৭১-এর ২৫ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালে হালিশহর ইপিআর ঘাঁটি থেকে মেজর রফিকের নেতৃত্বাধীন ইপিআর বাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ সময় দক্ষিণ হালিশহরের লোকজন নানাভাবে ইপিআর বাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতা করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে পাকবাহিনী।
খবর পেয়ে ২৯ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বঙ্গোপসাগর উপকূল হয়ে দক্ষিণ কাট্টলীর ইপিআর ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হয়। পরদিন পাকবাহিনী নগরীর উত্তরে গহনা খাল এবং দক্ষিণে ইপিআর ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকা ঘিরে ফেলে। সামান্য অস্ত্র নিয়ে ইপিআরের পক্ষে পাক বাহিনীকে মোকাবেলা করা সম্ভব ছিল না। এ অবস্থায় অধিকাংশ ইপিআর সদস্য এলাকা ত্যাগ করলেও ৪০-৪২ জন মধ্যম নাথপাড়ার বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নেয়।
বিহারিরা জল্ল¬াদ শওকতের নেতৃত্বে ৩১ মার্চ দুপুরের দিকে নাথপাড়ায় হত্যাকা- শুরু করে। বেছে বেছে তরুণ যুবকদের হত্যা করা হয়। তারপর বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। নারী ও শিশুদের আটকে রাখা হয় এক বিহারির ঘরে । পরে সেখান থেকে মেয়েদের ধরে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন চালানো হয় । 
ওইদিন বিহারিরা নাথ পাড়ার চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের বি কম শ্রেণির ছাত্র দুলাল এবং চট্টগ্রাম কলেজের অনার্সের ছাত্র বাদল এই দুই ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করে। চোখের সামনে এই দৃশ্য দেখে মা নিরুবালা অজ্ঞান হয়ে যান। পরে দুই ছেলের রক্ত দিয়ে ভিজিয়ে দেয়া হয় নিরুবালার শরীর। একই সময়ে হত্যা করা হয় নিরুবালার স্বামী হরিপদ নাথ ও শ্বশুর খীরোদ বাঁশী নাথকেও।
সেদিনের দুঃসহ ঘটনার স্বাক্ষী দুলাল ও বাদলের ছোট বোন খুকী দেবী বাসসকে বলেন, “ওইদিন সকালে ১০ থেকে ১২ জন ইপিআর সদস্য আমাদের ঘরে আশ্রয় নেয় এবং কিছু কাপড়-চোপড় চায়। আমার বাবা ও ভাইয়েরা তাদের কাপড় ও খাবার দেয়। খাওয়া শেষ করে ইপিআর সদস্যরা চলে যান। দুপুরের দিকে একদল বিহারি কিরিচ, কুড়াল নিয়ে আমাদের বাড়ি আক্রমণ করে এবং ইপিআর জাওয়ানদের বের করে দিতে বলে। 
এরপর বিহারিরা ঘরে ঢুকে চোখের সামনে আমার বড় দুই ভাইকে কুড়াল ও কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। সে দৃশ্য দেখে আমার মা অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পরে তারা আমার বাবা ও দাদুকেও হত্যা করে। বিহারিরা কুড়াল দিয়ে বড় ভাই দুলালকে হত্যা করলে আমি বাদলকে জড়িয়ে ধরে খাটের নিচে লুকিয়ে থাকি। কিন্তু সেখান থেকে বাদলকে টেনে এনে হত্যা করা হয়। এরপর মাটি থেকে ওদের রক্তমাখা দেহ উপরে তুলে আমার অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা মায়ের শরীরের ওপর ধরে বলে ‘গোসল কর ছেলেদের রক্ত দিয়ে। তোদের জয় বাংলা বেরিয়ে যাবে।’ এ সময় মায়ের পুরো শরীর আমার ভাইদের রক্তে ভিজে যায়।”
খুকী দেবী তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। হত্যাকা-ের পর বিহারিরা ঘরে আগুন লাগিয়ে দিলে খুকীর বাঁ হাত ও পা ঝলসে যায়। কোন রকমে দৌঁড়ে পাশের এক ছোট্ট ডোবায় ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মরক্ষা করেন তিনি। সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি আর দগ্ধ শরীর নিয়ে আজও অবিবাহিত জীবনযাপন করছেন খুকী দেবী। হাতের সেই পোড়া অংশ দেখাতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেন।
নিরুবালার বেঁচে থাকা ছোট ছেলে সুনীল নাথ বাসসকে জানান, ‘মুক্তিযুদ্ধে আমার দাদু, বাবা এবং বড় দুই ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সরকারের কাছে আমি কোন অনুদান বা সহানুভুতি চাই না। আমার দাবি আমাদের পরিবারকে শহীদ পরিবারের মর্যাদাটুকু যেন দেয়া হয়।’
পাড়ায় আগুন দেওয়ার পর অন্য নারী-পুরুষরা পাড়া ছেড়ে চলে যাওয়ায় এসব মৃতদেহের পরিণতি কী হয়েছিল তা জানা যায়নি। তবে স্বাধীনতার পর পাড়ায় ফিরে বহু মানুষের মাথার খুলি এবং হাড়গোড় পাওয়া যায়। মাটি খুঁড়েও অনেক কঙ্কাল পাওয়া গেছে। এখন পুরো এলাকায় ঘরবাড়ি উঠে গেছে। আর এভাবেই ইট-কাঠ-পাথরের নিচে চাপা পড়ে গেছে সব দুঃসহ স্মৃতি।
নাথপাড়ার এ নিমম হত্যাযজ্ঞ স্মরণ করে রাখতে কয়েক বছর আগে মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান, নাট্যকার-সাংবাদিক প্রদীপ দেওয়ানজী, কলামিস্ট সাখাওয়াত হোসেন মজনু, ও চিত্রশিল্পী ঢালী আল মামুনের উদ্যোগে ওই স্থানে একটি স্মৃতি ভাস্কর্য ‘শহীদ বেদী’ স্থাপন করা হয়।