শিরোনাম

দিদারুল আলম
ঢাকা, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৫(বাসস) : নির্বাসন বা কারাবাস কোনো নেতার রাজনীতির শেষ নয়। যুগে যুগে ইতিহাসে এটিই প্রমাণিত হয়েছে। আজ তারেক রহমানের বর্ণাঢ্য প্রত্যাবর্তনে তা আবারও প্রমাণ হল। এমন কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার মধ্যে ইরানের আয়াতুল্লাহ খোমেনি, রাশিয়ার ভøাদিমির লেনিন, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা ইতিহাসে নজির হয়ে আছেন।
দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসন শেষে দেশের মাটিতে তারেক রহমানকে লাখ লাখ মানুষের জনসমুদ্রে অকৃত্রিম ভালোবাসায় বরণ ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে আখ্যা পেল।
এই দীর্ঘ নির্বাসিত জীবনে থেকেও নেতৃত্ব দিয়ে দলকে সংগঠিত করার পাশাপাশি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম এবং চব্বিশের জুলাই আন্দোলনেও ছিল তারেক রহমানের গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
সেখানে বসেই দলের পক্ষ থেকে দেশের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা তুলে ধরেন তিনি। তার দেশে ফেরার ঘোষণার পর থেকেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাজ করছিল প্রাণচাঞ্চল্য।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তথা এক এগারোয় জরুরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে গ্রেফতারের পর তারেক রহমান নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হন। নির্যাতন, হয়রানি ও মিথ্যা মামলা নিয়ে প্রায় ১৭ বছর আগে তিনি দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। জনগণের ভালোবাসায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনিই এখন নন্দিত ও বহুল আকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিত্ব। যার অপেক্ষায় ছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও সমগ্র বাংলাদেশ। আজ ২৫ ডিসেম্বর সেই বহুল প্রতীক্ষার অবসান হল। দেশের ইতিহাসে আজকের দিনটি ‘ঐতিহাসিক’ হিসেবে স্থান করে নিল। তার ফেরার মূহূর্তে তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে তারেক রহমান একটি ছবি যুক্ত করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘দীর্ঘ ৬ হাজার ৩শ ১৪ দিন পর বাংলাদেশের আকাশে!’
এক এগারোর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মইনুল রোডের বাসা থেকে ২০০৭ সালের ৭ মার্চ বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর অজ্ঞাত স্থানে আটকে রেখে চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। ওই বছর ২৮ নভেম্বর আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিপীড়নের বর্ণনা তুলে ধরেছিলেন তিনি।
রিমান্ড, নির্যাতন, ৫৫৪ দিন বা ১৮ মাস কারাভোগের পর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান তারেক রহমান। লন্ডনে যাওয়ার পরও তার ওপর থামেনি মামলার খড়গ। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ১৩টি এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তার বিরুদ্ধে ৭২টি মামলা হয়। এর মধ্যে অন্তত পাঁচটি মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদ সাজা দেয়া হয় তাকে। এসব মামলায় আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি মুক্ত হন।
দীর্ঘ ১৭ বছরের অপেক্ষা শেষে আজ জন্মভূমিতে পা রেখেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে তারেক রহমানকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। পরে তারেক রহমান সেখানে উপস্থিত বিএনপি নেতাদের সঙ্গে আলিঙ্গন ও কুশল বিনিময় করেন।
এছাড়া বিমানবন্দরে ফুলের মালা দিয়ে তারেক রহমানকে বরণ করে নেন তার শাশুড়ি সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু।
বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ থেকে বের হয়ে খালি জায়গায় খালি পায়ে মাটি স্পর্শ করে একমুটো মাটি হাতে নেন তারেক রহমান।
এরপর বুলেট ফ্রুফ গাড়ি বাদ দিয়ে ‘সবার আগে বাংলাদেশ’ খচিত লাল সবুজের রং এর একটি বাসে চড়ে তার জন্য পূর্বাচলে ৩০০ ফিটে সংবর্ধনা মঞ্চের দিকে রওনা হন। তিন ঘন্টারও বেশি সময় লাগে বিমানবন্দর থেকে ৩০০ ফিটে সংবর্ধনা মঞ্চে পৌঁছাতে। পুরো রাস্তায় তিনি বাসটির সামনে থেকে লাখ লাখ নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্য হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান। নেতাকর্মী বাঁধ ভাঙ্গা উল্লাসে ফেটে পড়ে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ। নেতাকর্মীরা স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত করে রাখে।
সংবর্ধনায় ১৬ মিনিট বক্তব্য রাখেন তারেক রহমান। তার বক্তব্যে ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে জনমানুষের আকাংখা প্রকাশ পেয়েছে বলে ফেসবুক পেজে আগনিত মানুষ তাদের প্রতিক্রিয়ায় উল্লেখ করেন।
নির্বাসন বা কারাবাস কোনো নেতার রাজনীতির শেষ নয়। যুগে যুগে ইতিহাসে এটিই প্রমাণিত হয়েছে। জনগণের সমর্থন, আদর্শ ও সংগ্রামের শক্তিতে নেতা দীর্ঘ নির্বাসনের পর দেশে ফিরে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছেছেন। এমন কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার মধ্যে রয়েছেন ইরানের আযাতুল্লাহ খোমেনি,রাশিয়ার ভøাদিমির লেনিন, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা।
আয়াতুল্লাহ খোমেনি: ইরানের শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির স্বৈরশাসনের বিরোধিতার কারণে ১৯৬৪ সালে দেশত্যাগে বাধ্য হন আয়াতুল্লাহ খোমেনি। তাকে দীর্ঘ নির্বাসনে থাকতে হয়। তাকে প্রথমে তুরস্ক, এরপর ইরাক ও ফ্রান্সে নির্বাসিত জীবন কাটালেও সেখান থেকেই তিনি বিপ্লবী আন্দোলন চালিয়ে যান। ১৯৭৯ সালে শাহ সরকারের পতনের পর ওই বছরের ১ ফেব্রুয়ারি আয়াতুল্লাহ খোমেনি ইরানে প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরে ইসলামী বিপ্লবের নেতৃত্ব দেন এবং ইরানের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
ভøাদিমির লেনিন : রুশ জার শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কারণে লেনিন বারবার গ্রেপ্তার ও নির্বাসনের শিকার হন। তার প্রথম নির্বাসন নিজ দেশে ১৮৯৭ থকে ১৯০০ সাল। এরপর সাইবেরিয়া ও ইউরোপে নির্বাসিত অবস্থায় তিনি বলশেভিক মতাদর্শ গড়ে তোলেন। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় ফিরে অক্টোবরে বিপ্লব সংঘটিত করেন। লেনিনের নির্বাসনকালেই তার রাজনৈতিক চিন্তা পরিপক্ক হয় এবং রুশ বিপ্লবের সাফল্যে ভুমিকা রাখে।
নেলসন ম্যান্ডেলা : বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের কারণে ১৯৬৪ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পান নেলসন ম্যান্ডেলা। টানা ২৭ বছর কারাগারে থাকার পর ১৯৯০ সালে মুক্তি পান। পরে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে বর্ণবাদী শাসনের অবসান ঘটান এবং ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কারাগার ম্যান্ডেলার জীবনকে ঘৃণার বদলে ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার আদর্শে গড়ে তোলে।