শিরোনাম

আককাস সিকদার
ঝালকাঠি, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস): ঝালকাঠির ভয়াবহ গণহত্যার খবর উঠে এসেছিলো ১৯৭১ সালে ৯ নম্বর সেক্টর থেকে নুরুল আলম সম্পাদিত ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ পত্রিকায়। যার শিরোনাম করা হয়েছিল ’ঝালকাঠি না মাইলাই। অর্থাৎ ভিয়েতনামের মাইলাই গ্রামে মার্কিন সেনারা ১৯৬৮ সালের ১৬ মার্চ একদিনে ৫০৪ জন নারী-পুরুষকে বর্বোরচিত কায়দায় হত্যা করে। আর সেই হত্যাকেও হার মানিয়েছিল তখনকার হিন্দু অধ্যুষিত ঝালকাঠির গণহত্যা।
১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল ঝালকাঠি শহরে আগুন দেয়া থেকে শুরু করে আগস্ট মাস পর্যন্ত ঝালকাঠি ও নলছিটির বিভিন্ন এলাকায় গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। সারিবদ্ধভাবে পেছনে হাত বেঁধে নদীর পাড়ে একদিনে ১৯৫ জন সনাতন ধর্মাবলম্বীকে হত্যা, এমনকি আল্লাহর ঘর মসজিদ থেকে ধরে এনে ৯ জন মুসল্লিসহ ৩ দিনে ২২ জনকে হত্যা অথবা পার্শ্ববর্তী সব হিন্দু গ্রামের মাঝখানে মুসলিম অধ্যুষিত একমাত্র গ্রাম বেশাইনখানে ২৫ জন মুসলমানসহ ৩০ জনকে হত্যা-এই ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে পাকিস্তানিদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার বোঝা যায়। তারা গণহত্যার সময় রক্তের নেশায় হিন্দু বা মুসলিম না বরং বাঙালি নিধনকেই মাথায় রাখতো।
১৯৭ জন থেকে বেচেঁ যান একজন
ঝালকাঠি সদর উপজেলার পোনাবালিয়া থেকে ১২৮ জন ও সাচিলাপুর গ্রামের আশপাশ থেকে ৬৮ জনসহ মোট ১৯৬ জনকে ধরে নিয়ে একাত্তরের ৩০ মে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর পাড়ে (বর্তমান পৌর খেয়াঘাট) হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। গণহত্যার স্বীকার ১৯৬ জনের মধ্যে ১৯৫ জনই ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বী (হিন্দু)। আর এর মধ্যে আনসার আলী খান নামে একজন ছিলেন মুসলিম। তবে ১৯৬ জনের বাইরে শুধু ১৯৭তম ব্যক্তি হিসেবে একমাত্র বেঁচে গিয়েছিলেন বরিশালের অমল কংশবণিক। তিনি এই গণহত্যার জীবন্ত সাক্ষী।
অমল কংশবণিক বাসসকে জানান, আমাদের ১৯৭ জনকে ঝালকাঠি থানায় এক রাত রাখা হয়। ভোর থেকে চার-চারজন করে দীর্ঘ সারিতে সুগন্ধা নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়ে চারজন করে গুলি দিয়ে হত্যা করা হয়। শেষের দিকে এক পুলিশের দয়া হয় আমার মত ১০ বছরের বাচ্চাকে দেখে। রশি খুলে দিয়ে সে আমাকে পালাতে বলে। আমি নদী সাঁতরে কোনমতে ওই পারে উঠলে মাঝিরা আমাকে বাঁচায়।
ঘটনার দিনটি যে ৩০ মে, এটি জানান ঝালকাঠির স্থানীয় চাঁদ মোহন কংশবণিক। তিনি জানান, তার আপন বড় ভাই সতীশ চন্দ্র কংশবণিক, ভাইয়ের দুই ছেলে সুধীর চন্দ্র কংশবণিক ও সুনীল চন্দ্র কংশবণিকসহ এই বংশীয় আরো অনেককে হত্যা করা হয়। যার মধ্যে আছেন অনিল কংশবণিক, সুবল চন্দ্র কংশবণিক ও রাখাল চন্দ্র কংশবণিক। এছাড়া মনোরঞ্জন সাহা, গোপাল সাহা, রামপ্রসাদ চক্রবর্তী (ব্রাহ্মণ), নিরুপদী চক্রবর্তী, গৌরঙ্গ দাস (ধোপা), পরান সাহা, যামিনী সাহা, গুপিনাথ সাহা ও মদন সাহাসহ অনেককে হত্যা করা হয় সেদিন।
মসজিদের মুসল্লিদের গণহত্যা
অন্যদিকে ঝালকাঠি সদর উপজেলার কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের পশ্চিম দিকে বেশাইনখান গ্রাম আর পূর্ব দিকের একটি গ্রাম রমানাথপুর। দুটি স্থানে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা চালিয়েছে। বিশেষত রমানাথপুরের শরীফবাড়ী জামে মসজিদ থেকে মুসল্লিদের বের করে এনে হাত বেঁধে কোলায় (ফসলের মাঠ) দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা, যা ইতিহাসের নিকৃষ্টতম উদাহরণ।
স্থানীয় শহীদুল ইসলাম জানান, ওইদিন বারো চান্দের খুৎবা বইয়ের লেখক মাওলানা শরীফ আব্দুল কাদির সাহেব উপস্থিত থেকে পাক বাহিনীকে বাধা দিলেও তারা মুসল্লিদের মসজিদ থেকে নামিয়ে হত্যা করে। অধিকাংশের মতে ২১ মে মসজিদ থেকে বের করে ৯ জন মুসল্লিকে হত্যা করা হয়। এর আগে পাশের শশাঙ্ক হাওলাদার বাড়ির কাছারিঘর থেকে ৪ জনসহ আশপাশের ৮ জন এবং ২৩ মে রমানাথপুরের বিভিন্ন বাড়ি থেকে অজ্ঞাতসহ ৭-৮ জনকে হত্যা করা হয়।
পুরান চাঁদরে দাফন
ওই এলাকার স্থানীয় মোসলেম (মধু মাঝি) নিজের বাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে জানান, এইখানে আমার ভাই ও আব্বাকে কবর দিয়েছি। প্রথমে আমার ভাই লতিফ মাঝি ও চাচাতো ভাই হাশেম মাঝিকে মসজিদ থেকে ধরে এনে হত্যা করা হয়। এরপর বাড়ির সামনেই আমার আব্বা আহমেদ মাঝি ও চাচা আব্দুল মাঝিকে হত্যা করা হয়। এই হত্যা আমি নিজ চোখে দেখেছি। ওইদিনই পাশের গ্রামে আমার শ্বশুর এনাজুদ্দিন মিয়া, তার ছেলে নুরুল হক মিয়া ও ভাই আব্দুল হাকিম মিয়াকে গুলি করে মারা হয়। চোখের সামনে গুলি দিয়ে মেরেছে আমার ভাই, বাবা, চাচা ও চাচাতো ভাইকে। আমার ভাইয়ের হাতের আঙ্গুল উড়ে গেছে ভাইয়ের বুকটা ঝাঁজরা করে ফেলছে। একটা টিনে করে লাশ এনে পুরান একটি চাঁদরে মুড়িয়ে লাশ দাফন করেছি।
স্থানীয় আমিনুল ইসলাম জানান, সেদিন মসজিদ থেকে ৯ জনকে ধরে নিয়ে আমাদের হাওলাদার বাড়ির দরজায় বেঁধে রেখে ফায়ার করে। আট জন ওখানেই মারা যায় এবং একজন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। এসময় ওই পথেই আসছিল রমানাথপুরের পোস্টমাস্টার শাহজাহান হাওলাদার। তাকে দেখামাত্রই হানাদাররা গুলি করলে সে পুকুরে পড়ে মারা যায়।
পোস্টমাস্টার শাহজাহান হাওলাদারের স্ত্রী জমিলা বেগম জানান, আমার স্বামীকে গুলি করে মারার দুদিন আগে ১৯ মে শুক্রবার আমার একটি ছেলে হয়েছিল। ২১ মে রোববার তাকে হত্যার ৫ দিন পর ২৬ মে শুক্রবার ৭ দিন বয়সে ছেলেটাও মারা যায়। ওর আব্বা নাম রেখেছিলো এনায়েত। আড়াই বছরের আরেক ছেলেকে নিয়ে ৫৪ বছর আগে বিধবার জীবন বেছে নিয়েছিলেন তিনি। নামমাত্র কবরের চিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে যুদ্ধকালীন স্বামীর প্রশিক্ষণ নোটের কাগজ হাতে বলেন, ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবের পাঠানো দুই হাজার টাকার একটি চেক পেয়েছিলাম, এর বাইরে এখন পর্যন্ত স্বামীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বা কবরটাও বাঁধিয়ে দেয়নি কোন সরকার।
গর্ভে থাকা সন্তানকে নিয়ে ৫৪ বছর
শরীফ বাড়ি মসজিদ থেকে ধরে আনা জেন্নাত আলী মৃধাকে অন্যদের সঙ্গে যখন হত্যা করা হয় তার স্ত্রী সকিনা বেগমের গর্ভে তখন একটি ছেলে আর তিন বছর ও দেড় বছরের দুটি মেয়ে ছিল। গর্ভের সেই ছেলে ৫৪ বছরের আব্দুল গনি দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন।
বৃদ্ধা সকিনা বেগম আহাজারি করে বলেন, ‘এতো বছর যেহেতু অসহায়ভাবে কাটাইছি এখন আর সরকারের কাছে কিছু চাই না, কিন্তু যে এই দেশের জন্য মরলো তার কবরটা করে দিক। শরিফ বাড়ি পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে শহীদ আব্দুস সালামকে। পায়ে হেঁটে পাঁচ মিনিটের পথ এগিয়ে আরেকটি গোরস্থানে শহীদ আবুল হোসেন মাঝির কবর পাওয়া যায়।

রমানাথপুর শরীফবাড়ি মসজিদের ঘটনায় ওইদিন একমাত্র বেঁচে যান শশাঙ্ক গ্রামের পাশের আলিপুর গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক খান। তার ছেলে মিজানুর রহমান খান জানান, একমাত্র আমার বাবা বেঁচে গেলেও আমার আপন বড় চাচা আবদুল জব্বার খান শহীদ হন। আব্বাও ২০১০ সালে মারা যান। ওই দিন মোট ১৭ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। প্রসঙ্গত, আব্দুল জব্বার খানের আড়াই বছর বয়সী হাসিনা পারভীন নামে একটি মেয়ে ছিল। পরে তার বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করেন বেঁচে যাওয়া ছোটভাই রাজ্জাক খান। সেই সংসারে তিন মেয়ে নূপুর, ঝুমুর, মুক্তা ও এক ছেলে মিজানুর রহমান খান।
আলিপুর গ্রামের স্থানীয় আকবর হোসেন শহীদ জব্বার খানের পুরাতন বাড়িতে তার কবর দেখিয়ে বলেন, এর কবরটাও সরকার বাঁধাই করেনি। শুনেছি সে মারা যাওয়ার পর পরিবারকে সাহায্যস্বরূপ দুই হাজার টাকার চেক ছাড়া আর কোন স্বীকৃতিই এ পর্যন্ত দেয়া হয়নি।
শরিফবাড়ি মসজিদের ঘটনায় শহীদ আফসার আলী হাওলাদারের কবরও আলিপুর গ্রামে। পুত্রবধূ রোকসানা বেগম জানান, তার স্বামীকে দেড় ও ননদকে ৫ বছরের রেখে যান। শহীদের কবরের নামমাত্র নিশানা তিনি দেখাতে পেরেছেন।
একই মসজিদ থেকে হত্যার স্বীকার আবদুর রাজ্জাক কারিগরের কবর আলিপুরে। পুত্রবধু মাহিনুর জানান, তার স্বামী সেলিম কারিগর তখন মায়ের গর্ভে। শাশুড়ি ফাতেমা বেগমের কোলে হারুন ও হালিম নামে আরও দুই ছেলে ছিল। একটি খোলা গোরস্থানে হাতের ইশারায় তাদের কবর দেখালেন পুত্রবধূ।
স্থানীয় নজরুল ইসলাম কারিগর জানান, তার আব্বা আদম আলী কারিগরও শরীফবাড়ি মসজিদের ঘটনায় পুকুরে লাফ দিয়ে বেঁচে যান। কয়েক বছর আগে তিনি মারা গেলে তাকেও শহীদ আবদুর রাজ্জাকের পাশে সমাহিত করা হয়।
বাবা ও সন্তানের কবরের নেমপ্লেট একসঙ্গে
শশাঙ্ক গ্রামের হাওলাদার বাড়ির নিজ কাছারি ঘরে একাত্তরের ২১ মে হানাদার বাহিনীর গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন মেসের উদ্দিন হাওলাদারসহ চান্দে আলী মোল্লা, শাহাজউদ্দিন হাওলাদার ও পাশের বাড়ির আবেদ আলি হাওলাদার। গোলাগুলি দেখে শাহাজউদ্দিনের ছেলে সোবহান হাওলাদার দৌঁড় দিলে বাড়ির বেড়ের (নালা) পাশে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মেসের উদ্দিন হাওলাদার শহীদ হওয়ার দুদিন পরেই পাশের রমানাথপুরে মসজিদ থেকে নিয়ে হত্যা করা হয় তার ছেলে আবদুল মান্নান হাওলাদারকে (বি কম)।
স্থানীয় আব্দুর রব হাওলাদার জানান, তার ভাই সে সময় চামটা মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। পারিবারিক কবরস্থানে বাবা ও সন্তানের কবরের নেমপ্লেট একসঙ্গে। উল্লেখ করা আছে মৃত্যু তারিখ ২১ ও ২৩ মে। আর এই তারিখটি থেকে বোঝা যায় শরীফবাড়ি মসজিদের ঘটনাটি ২৩ মের। কিন্তু অধিকাংশের মতে ২১ মে মসজিদ থেকে বের করে ৯ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এর আগে হাওলাদার বাড়ির কাছারিঘর থেকে ৪ জনসহ ৮ জন এবং ২৩ মে রমানাথপুরের বিভিন্ন বাড়ি থেকে অজ্ঞাতসহ ৭-৮ জনকে হত্যা করা হয়।
কাছারিঘরে হত্যার পরে পাশের বাড়ির আব্দুল কাদের এবং দৌঁড়ে যাওয়া নবম শ্রেণির ছাত্র দেলোয়ার হোসেনকে হত্যা করা হয়। শহীদ আবেদ আলীর ছেলে আবদুল ওয়াহেদ দেখান বাড়ির একই কবরস্থানে তার বাবা শহীদ আবেদ আলী ও শহীদ আব্দুল কাদেরের কবর। কাছারিঘর ও বাইরের কয়েকটি হত্যার সাক্ষী শহীদ শাহাজ উদ্দিনের ভাইয়ের মেয়ে পারুল বেগম চাচা শাহাজ উদ্দিন ও চাচাতো ভাই শহীদ সোবহানের কবর শশাঙ্ক এলাকার একটি গোরস্থানে চিহ্ন দিয়ে দেখান।
স্থানীয় হাবিব জানান, মনসুর নামেও একজন মারা যায় সেদিন। দেবরকে বিয়ের ৫৪ বছর পর মৃত্যু শহীদ আবেদ আলীর স্ত্রী রোকেয়া বেগম আশি বছর বয়সে গত বছর সপ্তম রমজানে মারা যান। একাত্তরে আবেদ আলীর মৃত্যুর সময় তার ১০ বছরের ছেলে আ. ওয়াহেদ, ৭ বছরের শহীদ, দুই বছরের কালাচাঁন ও ছয় মাসের ইব্রাহীম নামে চার ছেলে ছিল।
শহীদদের কারো কারো স্ত্রীর গর্ভে ছিল সন্তান। কেউবা সন্তানের মুখ দেখার দুদিন পরই শহীদ হয়েছেন। কেউ গর্ভের সন্তান নিয়ে বিধবার জীবন বেছে নেন। কোন কিশোর তার বাবা ভাইয়ের রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত লাশ ঢেউটিনে বয়ে এনে পুরান চাঁদর মুড়িয়ে দাফন করেন। অথচ এই শহীদদের বেশির ভাগই মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫৪ বছর পরেও শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি। কারোর কবর বাঁধানোতো দূরের কথা নিশানা সাইনবোর্ডও লাগানো হয়নি। যে স্থানে মসজিদ থেকে বের করে হত্যা করা হয়েছে সেখানেও ৫৪ বছরে হয়নি কোনো স্মৃতিসৌধ বা নামফলক! বেশাইনখান গণহত্যা।
১৯৭১ সালের ২১ জুন ১৩৭৮ বঙ্গাব্দের সাত আষাঢ় ভোর হওয়ার আগেই ঝালকাঠির কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের বেশাইনখানে পাকিস্তানি হানাদারদা আক্রমণ চালিয়ে অন্তত ৩০ জনকে হত্যা করে। এ তথ্যটি স্থানীয় শহীদ স্মৃতিসৌধে খোদাই করা আছে।
স্থানীয় গোলাম মোস্তফা জানান, ঘটনার দুদিন আগে আমিসহ কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যায় হানাদাররা। আমাদের কাছে শশাঙ্ক মানিকসহ কয়েকজনের সন্ধান চায় হানাদাররা। এর দুদিন পরেই ভোররাতে তারা আমার আপন বড়ভাই মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানকেও হত্যা করা হয়। আমার ভাই তখন ঢাকার নিউ পল্টনের একটি কলেজের ছাত্র।
নামফলকে উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী, শহীদরা হলেন- এবিএম হাতেম আলী মোল্লার দুই ছেলে এ কে এম রেজাউল করিম মানিক, মোহাম্মদ সাইদুল করিম রতন; নূর মোহাম্মদ মোল্লার দুই ছেলে মুহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, মোহাম্মদ এনায়েত হোসেন, ফয়েজ উদ্দিন মোল্লার দুই ছেলে মো. জহুরুল হক মোল্লা, আব্দুল মালেক মোল্লা; ছবদার আলী মোল্লার ছেলে মোবাখখের আলী মোল্লা ও তার ছেলে মোহাম্মদ খলিলুর রহমান; আমজাদ হোসেন মোল্লার ছেলে এ কে এম সালাউদ্দিন মজনু, আব্দুল কাদের মোল্লার ছেলে আব্দুল মালেক মোল্লা, আজাহার আলী মোল্লার ছেলে মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, আলিমুদ্দিন মোল্লার ছেলে আব্দুর রহিম মোল্লা, বুরজুগ আলী মোল্লার ছেলে মোহাম্মদ ওয়াহাব আলী মোল্লা, হেলাল উদ্দিন মোল্লার ছেলে মোহাম্মদ রাশেদ আলী মোল্লা, এমরান উদ্দিন মোল্লার ছেলে মোহাম্মদ ফজলুল হক মোল্লা, মোজাহার আলী মোল্লার ছেলে আব্দুল মজিদ মোল্লা, আব্দুল গফুর মোল্লার ছেলে মো.ইসমাইল মোল্লা, আব্দুল মোল্লার ছেলে আব্দুল করিম মোল্লা, আফতাব আলী মোল্লার ছেলে মোহাম্মদ ইউসুফ আলী মোল্লা, তোফাজ্জল হাওলাদারের ছেলে আব্দুল মান্নান হাওলাদার, গঞ্জে আলী হাওলাদারের ছেলে মোহাম্মদ জলিল উদ্দিন হাওলাদার, আজমত আলী হাওলাদারের ছেলে মোহাম্মদ মোক্তার আলী হাওলাদার, আজাহার সরদারের (গোবিন্দধবল) ছেলে আব্দুস সাত্তার সরদার রয়েছেন। এছাড়া আবু বকর মাস্টার, শ্রীদেব কুমারসহ দুই অজ্ঞাত শহীদ রয়েছেন। সিংহপুরের পার্বতী চরণ হালদারের ছেলে শ্রী মহেন্দ্রনাথ হালদার, খাজুরার বসন্তকুমার বালার ছেলে শ্রী জুরানা বালা ও মিরাকাঠির শরৎ হালদারের ছেলে শ্রী রাজেন হালদার রয়েছেন ওই শহীদদের তালিকায়।
সম্প্রতি সরজমিনে ঘুরে ওই এলাকার কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে সরকারিভাবে বাঁধাই করা ৫টি শহীদ কবর পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে একেএম রেজাউল করিম মানিক, একেএম সালাউদ্দিন মজনু, মো. হাবিবুর রহমান, আ. রহিম মোল্লা ও মো. ফজলুল হক মোল্লার কবর রয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ঘাঁটি এলাকা পেয়ারাবাগান থেকে বিপ্লবী কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন সর্বহারা পার্টি চলে যাওয়ার পরেই বেশাইনখানে এই গণহত্যা চালানো হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন পূর্ববাংলার জাতীয় মুক্তিবাহিনীর পলিটিক্যাল কমিশার কমরেড খুরশীদ আলম খসরু।
এ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন কবির জানান, আমার আপন মামা আনসার আলী খানকে ঝালকাঠি বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি করে শহীদ করা হয়। সাংবাদিক ফজলুল বারি পায়ে হেঁটে-হেঁটে ৬৪টি জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের অংশ হিসেবে যখন ঝালকাঠি আসেন তিনি সাত দিন আমার সঙ্গেই ছিলেন। তখন থেকে এই কীর্ত্তিপাশার রমানাথপুর, বেশাইনখানসহ অনৈক বধ্যভূমিতে পায়ে হেঁটে বহুবার ঘুরেছি। এখনও মুক্তিযুদ্ধ রক্তের মধ্যে বাজে বলে ঘুরেঘুরে দেখি কোথায় শহীদের কবর, কোথায় তাদের স্মৃতি?
রশীদ সরদারের স্ত্রী প্রতিদিন কবরের কাছে কাঁদতেন
ঝালকাঠি শহরের গণহত্যায় শহীদ হওয়া রশিদ সরদারের ছোট ভাই এস এম শাহজাহান বাসসকে জানান, আমার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে ২০ মে। তখন আমার ভাবির গর্ভে একটি মেয়ে সন্তান। শহরের মেথর বাড়ি এলাকায় পৌর চেয়ারম্যান রেজ্জেক, লাল মিয়া, সলিমুদ্দিন ও ডিএস ইসলামকে পেয়ে চেয়ারম্যানের হাত ধরে অনেক অনুরোধ করে বলেছিলাম, জায়গা জমি সব লিখে দিয়ে আমরা এদেশ ছেড়ে চলে যাবো। আমার ভাইরে ছেড়ে দেন। পাশে থাকা লাল মিয়া একটি কথাও বললো না। কারণ আমার ভাইকে সে-ই ধরিয়ে দিয়েছে।
তিনি জানান, পরের দিন সকালে খবর পাই ভাইকে গুলির আদেশ হইছে। আমার ভাবি ও আমি যাওয়ামাত্র ভাই গায়ের জামা আর তাবিজ খুলে দিল। আমাকে বলল, তুই এখন আইছো? আমারে বাড়ির দরগায় কবর দিস। এরপর আমাদের সরিয়ে দিয়ে শহরের লিচু বাগানের পারে আমার ভাইসহ অন্যদের গুলি দিলো। দুইদিন পরে গুরুধাম খালের মাথায় তার মরদেহ পাই। পরে বাড়ির সামনের দরগাহে তাকে দাফন করা হয়। ঝালকাঠি শহরের শীতলাখোলার মোড়ে শহীদ রশীদ সরদারের নামে একটি গেট করা হয়েছে।
ঝালকাঠি প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট আককাস সিকদার এ প্রসঙ্গে বলেন, শহীদ রশীদ সরদারের স্ত্রীকে আমরা ছোটোবেলায় প্রায় ভোরেই দেখতাম স্বামীর কবরের কাছে বসে বসে কাঁদতেন।

একাত্তরে ঝালকাঠি থানার সেকেন্ড অফিসার এবং বিজয়ের পর একই থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী অবসরপ্রাপ্ত এআইজি শফিউল ইসলাম বাসসকে জানান, ১৯৭২ সালে তার তত্ত্বাবধানে ঝালকাঠি শহরের সুগন্ধা নদীর পারের একটি গণকবর থেকে প্রায় ২০০ মাথার খুলি তোলা হয়। ওই খুলি বর্তমান সিটি পার্কে সমাহিত করা হয় এবং এ খুলির ওপরই নির্মাণ করা হয় শহীদ মিনার।