বাসস
  ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬:৫২
আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭:৫৭

অবৈধ সব ইটভাটা গুড়িয়ে দেওয়া হবে 

ছবি : বাসস

আব্দুর রাজ্জাক

কুষ্টিয়া, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও অরাজকতার সুযোগে সরকারি নীতিমালা উপেক্ষা করে কুষ্টিয়ায় অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে ইটভাটা। যে সব ইটভাটার পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই তারাও কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই অবৈধ ভাটা চালিয়ে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, কৃষিজমিতে গড়ে ওঠা ইটভাটাগুলোতে প্রকাশ্যে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। যা স্থানীয় জনজীবন ও কৃষির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। 

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার ছয় উপজেলায় ইটভাটার সংখ্যা ২১৩টি। এর মধ্যে বৈধ ছাড়পত্র নিয়ে চলানো হচ্ছে মাত্র ১৭টি। অন্য ১৯৬টি চলছে পরিবেশের ছাড়পত্র ও লাইসেন্সবিহীন। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী বৈধ ইটভাটার মধ্যে ভেড়ামারা উপজেলায় ৩টি, দৌলতপুরে ১টি, কুমারখালী উপজেলায় ৯টি এবং খোকসা উপজেলায় ৪টি ইটভাটা রয়েছে। যার মধ্যে ২টি অটো ব্রিকস এবং বাকী ১৫টি জিগজ্যাগ। তবে কুষ্টিয়া সদর এবং মিরপুর উপজেলায় নেই কোনো বৈধ ইটভাটা। অবৈধ ১৯৬টি ইটভাটার মধ্যে ১টি অটো, ৪২টি জিগজ্যাগ, ২৯টি ড্রাম চিমনি এবং ১২৪টি উচ্চতার পাকা ফিক্সড চিমনি। 

অবৈধ ১৯৬টি ইটভাটার মধ্যে ২১টি ইটভাটার মালিক হাইকোর্টে রিট করার কারণে রিট নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তর ওই সব ইটভাটার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে না বলে কুষ্টিয়া পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র নিশ্চিত করেছে। 
স্থানীয়দের দাবি, সরকারি আইনে কৃষি নষ্ট করে ইটভাটা স্থাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু তা সত্ত্বেও কমপক্ষে প্রতিটি ইটভাটার জন্য তিন-চার একর কৃষিজমি নষ্ট করে ইটভাটা স্থাপন করেছে প্রভাবশালীরা। আইনের ফাঁক-ফোকর গলিয়ে জেলায় গড়ে উঠেছে এসব অবৈধ ইটভাটা। প্রতি বছরের মতো এবারও চলতি মৌসুমের শুরুতেই কৃষিজমি ও নদীর পলি মাটি কেটে ইটভাটাগুলোতে প্রস্তুত করা হচ্ছে নতুন ইট। এতে জেলায় কৃষিজমি হ্রাস ও উদ্বেগজনক ভাবে কমছে খাদ্যশস্য উৎপাদন। 

পরিবেশ অধিদপ্তরের নীতিমালা অনুযায়ী, ইটভাটার লাইসেন্স পেতে প্রস্তাবিত আবেদনপত্রের সঙ্গে ইট তৈরিতে মাটির উৎস উল্লেখ করে জেলা প্রশাসকের কাছে হলফনামা দাখিল করা বাধ্যতামূলক । তবে এ শর্ত ভাটা মালিকদের অধিকাংশই মানছে না। ফলে বেআইনিভাবে কৃষিজমি ও নদী তীরের পলি মাটি কেটে প্রস্তুত করা হচ্ছে ইট। 

স্থানীয় কৃষক শরিফুল হোসেন বাসসকে বলেন, ইটভাটার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষিজমি। এছাড়া দেদারসে কাঠ পুড়িয়ে উজাড় করা হচ্ছে ফলদ-বনজ সম্পদ। ইটভাটার নির্গত ধোঁয়া ও ছাই ফসলের ক্ষতি, পরিবেশ দূষণসহ জনজীবন ক্ষতিগ্রস্ত করছে চরমভাবে। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বৈধ ভাটা মালিক বলেন, ইটভাটা মালিক সমিতির শক্তিশালী সিন্ডিকেটের প্রভাব, অর্থবিত্ত ও তদবিরে পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা অবৈধ ভাটা উচ্ছেদে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছেন না। এছাড়া কতিপয় ভাটা মালিক উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়ে সৃষ্টি করেছে আইনি প্রতিবন্ধকতা। প্রতি বছর কিছুসংখ্যক ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হলেও পরবর্তী সময়ে অদৃশ্য কারণে তা আর কার্যকর হয় না। 

পরিবেশ গবেষক গৌতম কুমার রায় বাসসকে বলেন, দেশের ১০ হাজার ইটভাটার মধ্যে ৪ হাজার অবৈধ। প্রত্যেক ভাটায় কমবেশি ৯৫ শতাংশ কাঠ পোড়ানো হয়। তাতে আমাদের দেশে বছরে ইটভাটায় ২৫০ লাখ মেট্রিক টন কাঠ পোড়ানো হয়। মাটির উপরিভাগে (টপ সোয়েল) বৃষ্টি, বন্যার পানি ও গাছপালা পচার কারণে উর্বর শক্তি থাকে। সেই সাথে পরিবেশবান্ধব অণুজীব থাকে। মাটি  পোড়ানোর কারণে টপ সোয়েল টোটালি ধ্বংস করে ফেলছে। ফলে উর্বরা শক্তি হারাচ্ছে। এছাড়া মাটি কাটার ফলে ওই জমি কৃষি কাজ কিংবা জলাশয় কোনো কাজেই আসছে না। 

পাশাপাশি নির্মল বায়ু দূষিত হচ্ছে। ধোঁয়ার সাথে ক্ষার ছড়াচ্ছে। এই ক্ষার মানুষের নিশ্বাসের সাথে ভেতরে ঢুকে ক্ষতি করছে। গাছের বেঁচে থাকার শক্তি নষ্ট হচ্ছে। সুতরাং ইট ভাটায় ব্লক ইট তৈরি এখন সময়ের দাবি। সিমেন্ট ও বালু দিয়ে তৈরি এই ইট পরিবেশ বান্ধব। 

কুষ্টিয়া ইটভাটা মালিক সমিতির একাংশের সাধারণ সম্পাদক শাহীন আলী বাসসকে বলেন, আমাদের নিয়ন্ত্রণে ৭৩ টি ইটভাটা রয়েছে। ৮ থেকে ৯টা বাদে সবাই কয়লা ব্যবহার করেন। পরিবেশের ছাড়পত্র আছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, বাংলাদেশের কারো পরিবেশের ছাড়পত্র নেই। যদি তাই হয়, তাহলে সবাই অবৈধ। আমরা নিয়মিত সরকারকে রাজস্ব দিচ্ছি। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমল থেকেই বন্ধ রয়েছে।

কুষ্টিয়ার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার হোসেন ইমাম বলেন, ইট ভাটার কালো ধোয়া মানব শরীরের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ। এতে ফুসফুসের ক্ষতি হয়। এর ফলে শ্বাসকষ্টসহ ফুসফুসের  মারাত্মক প্রদাহ তৈরি হতে পারে। কালো ধোয়ার কারণে মানুষের নানারকম দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

অধ্যাপক শিহাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ইটভাটার কালো ধোয়া পরিবেশের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনছে। এ কারণে আমাদের চাষকৃত কৃষি জমি উর্বরতা হারাচ্ছে। ফসলের ব্যাপক ক্ষতি ও  পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে ।

জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর কুষ্টিয়ার উপপরিচালক মো. ইমদাদুল হক বাসসকে বলেন, অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকিগুলোতেও অভিযান চালানো হবে। কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পর্যায়ক্রমে সব অবৈধ ইটভাটা গুড়িয়ে দেওয়া হবে।