বাসস
  ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯:৪৪

বারুদের গন্ধ উপেক্ষা করে কুমিল্লার মানুষ সেদিন মুক্তির আনন্দে মেতেছিল

ছবি : বাসস

দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ

কুমিল্লা (দক্ষিণ) ৭ ডিসেম্বর ২০২৫ (বাসস) : আগামীকাল ৮ ডিসেম্বর। কুমিল্লা মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী বীরোচিত লড়াইয়ের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখলমুক্ত হয় কুমিল্লা। 

বহু ত্যাগ, রক্তধারা আর অগ্নিঝরা দিনের পর এই ভোরে কুমিল্লার আকাশে ওড়ে স্বাধীনতার পতাকা। এই দিন কুমিল্লার বাতাসে ছিল বারুদের গন্ধ। মাটিতে রক্তের দাগ। এসব উপেক্ষা করে কুমিল্লার মানুষ অপার উচ্ছ্বাসে মেতেছিল। 

কুমিল্লা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শুরু থেকেই কুমিল্লা অঞ্চলে পাক বাহিনীর অবস্থা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। পুরো জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বিশেষ করে কুমিল্লা সদর, ব্রাহ্মণপাড়া, চৌদ্দগ্রাম, বুড়িচং ও লালমাই এলাকাজুড়ে মুক্তিযোদ্ধারা শক্তিশালী প্রতিরোধের ঘাঁটি তৈরি করেন।

পাকিস্তানি দখলদারদের ওপর তারা টানা আক্রমণ চালাতে থাকেন। স্থানীয় মানুষের সহযোগিতা, তথ্য সংগ্রহ ও নিরাপত্তা সহায়তা মুক্তিবাহিনীর কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।

৭ ডিসেম্বর রাত ছিল কুমিল্লা মুক্তির চূড়ান্ত প্রস্তুতির রাত। ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ১১ গুর্খা রেজিমেন্ট এবং মুক্তিযোদ্ধা, গেরিলারা তিন দিক থেকে সমন্বিত আক্রমণ চালান কুমিল্লা বিমানবন্দর এলাকায় পাক বাহিনীর প্রভাবশালী ঘাঁটির ওপর। সেখানে অবস্থান করছিল পাকিস্তানি সেনাদের আতঙ্কের নাম ২২ বেলুচ রেজিমেন্ট।

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় প্রচণ্ড গোলাগুলি, ট্রেসার বুলেট আর মর্টারের গর্জন। তীব্র প্রতিরোধের মুখে পাক সেনারা বিমানবন্দর এলাকা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের দিকে অতিরিক্ত অস্ত্র ও সৈন্য পাঠানোর চেষ্টা করে। কিন্তু যৌথবাহিনীর সুসমন্বিত আক্রমণে তাদের সবকটি রুট ব্যর্থ হয়ে যায়।

মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় জনগণকে পূর্বেই সতর্ক করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেন। এরপর গভীর রাতে তারা চারদিক থেকে কুমিল্লা সেনানিবাস ঘিরে ফেলে। রাতজুড়ে তুমুল লড়াইয়ের পর ভোরের আলো ফোটার আগেই পাক বাহিনীর অবস্থান ভেঙে পড়ে।

৮ ডিসেম্বর ভোরে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। অস্ত্র ছেড়ে দিয়ে শতশত পাক সেনা যখন আত্মসমর্পণ করছিল, তখন কুমিল্লার আকাশ বাতাস বিজয়ধ্বনিতে প্রকম্পিত হচ্ছিল।

ভোরের প্রথম আলোয় থেমে যায় সমস্ত গোলাগুলির শব্দ। এরপরেই নেউরা, রাজাপাড়া, ঢুলিপাড়া, লক্ষ্মীপুর এবং চৌয়ারা এলাকায় দেখা যায়  পাক সেনাদের অসংখ্য লাশ। এই ভয়াবহ দৃশ্যের মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের এক অক্লান্ত অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে কুমিল্লায়।

সকাল গড়াতেই শহরের কান্দিরপাড়, রাণীরবাজার, টাউন হল, ধর্মসাগর পাড় সবখানে মানুষ নেমে আসে স্বাধীনতার আনন্দে। কেউ ঢোল বাজাচ্ছেন, কেউ পতাকা হাতে ছুটছেন। আর অনেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের বুকে জড়িয়ে কাঁদছেন। শহরের বাতাসে তখনো ধোঁয়ার গন্ধ, মাটিতে রক্তের দাগ, তবে মানুষের চোখে অপার উচ্ছ্বাস।

কুমিল্লার মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মতিন সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বাসসকে বলেন, ‘কুমিল্লা ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কৌশলগত এলাকা। এখানে জয় নিশ্চিত হওয়ায় চট্টগ্রামসহ পূর্বাঞ্চলের যুদ্ধ পরিস্থিতি আমূল বদলে যায়। এই বিজয় ছিল চূড়ান্ত স্বাধীনতার পথকে আরও ত্বরান্বিত করার ধাপ।’

অনেক মুক্তিযোদ্ধাই মনে করেন, ৮ ডিসেম্বরের বিজয় ছাড়া ১৬ ডিসেম্বরের মহান বিজয় এত দ্রুত অর্জন করা সম্ভব হতো না। কারণ কুমিল্লা মুক্ত হওয়ার মাধ্যমে ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরের সামরিক রসদ সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনী কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পূর্বাঞ্চলের বিশাল অংশ থেকে।

মুক্তিযোদ্ধা মোতাহের হোসেন বাবুল বলেন, এই বিজয় কেবল একটি এলাকার মুক্তি নয়, এটি ছিল এক জাতির সম্মিলিত শক্তির প্রতীক। ৩০ লাখ শহীদ এবং হাজার হাজার নির্যাতিত নারীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীন ভূখণ্ডকে সুরক্ষিত রাখা এখন প্রজন্মের দায়িত্ব।

মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান বলেন, বিজয় অর্জন করতে আমরা জীবন দিয়েছি। বিজয় রক্ষা করতে নতুন প্রজন্মকে বুকে চিতিয়ে দাঁড়াতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, দখলের বিরুদ্ধে, অসত্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। 

কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নূরে আলম বলেন, কুমিল্লা মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরো পূর্বাঞ্চলের সামরিক কৌশলের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এখানে জয় পাওয়ার পর মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা আরও গতিশীল হয়ে ওঠে। শাহাপুর, সদর দক্ষিণ, মুরাদনগর, দেবীদ্বার বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্তিশালী ঘেরাটোপ তৈরি করেছিল। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কুমিল্লাবাসী তাই গর্বের সাথে স্মরণ করছে সেই সব দেশপ্রেমিক যোদ্ধাদের, যাদের বুকের রক্তে রাঙা হয়েছিল এই জেলার মাটি। 

৮ ডিসেম্বর কুমিল্লা মুক্ত দিবস তাই কেবল একটি তারিখ নয়। এটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক চির অম্লান দিন। স্বাধীনতার বেদিমূলে হাজারো বীরের ত্যাগের প্রজ্বলিত মশাল। 

গৌরবোজ্জ্বল এই দিনের স্মৃতিতে বীর শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাতে কুমিল্লাবাসী নানা আয়োজন করেছে। কুমিল্লা মুক্ত দিবস উপলক্ষে জেলা প্রশাসন ১০ দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। 

কুমিল্লা জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. সাইফুল ইসলাম বাসসকে জানান, ৮ ডিসেম্বর কুমিল্লা মুক্ত দিবস উপলক্ষে বিকেলে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত পরিবেশনা শেষে কুমিল্লা টাউন হল মাঠে সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। পরে মাঠ থেকে একটি বর্ণাঢ্য বিজয় শোভাযাত্রা বের হবে। শোভাযাত্রা শেষে পুনরায় টাউন হল মাঠে এসে ১০ দিনব্যাপী বিজয় মেলার উদ্ধোধন করা হবে। এ শোভাযাত্রায় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন, স্কুল-কলেজ, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ অংশ নেবেন।