শিরোনাম

আব্বাছ হোসেন
লক্ষ্মীপুর, ৪ ডিসেম্বর ২০২৫(বাসস): আজ ৪ ডিসেম্বর। লক্ষ্মীপুর হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে লক্ষ্মীপুর শহরের বাগবাড়িস্থ পাকবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামসের সর্বশেষ ঘাঁটি দখলে নেওয়ার মাধ্যমে লক্ষ্মীপুর জেলা হানাদারমুক্ত হয়।
এদিন ভোরে শহরের বাগবাড়িস্থ হানাদার বাহিনীর সর্বশেষ ও প্রধান ঘাঁটিতে ত্রি-মুখী আক্রমণ করে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল গুলিবর্ষণের মুখে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় ওই ঘাঁটির দুই শতাধিক রাজাকার। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের খবর টের পেয়ে আগেই পাক বাহিনীর সদস্যরা ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়ে যায়। এই আক্রমণে নেতৃত্ব দেন মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হায়দার চৌধুরীর গ্রুপ, অ্যাডভোকেট আখতারুজ্জামানের গ্রুপ ও মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার আব্দুল মতিন-এর গ্রুপ। লক্ষ্মীপুরে হানাদারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ প্রতিরোধ ছিল এটি।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে ৩৭টি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয় রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধারা। যুদ্ধে শহীদ হন ১১৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে লক্ষ্মীপুরের মুক্তিযোদ্ধারা পাক বাহিনীর সাথে ১৯ টি সম্মুখ যুদ্ধ ও পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে ২৯ টি দু:সাহসিক অভিযান পরিচালনা করে।
এছাড়া লক্ষ্মীপুরের মুক্তিযোদ্ধারা নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার বগাদিয়া যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। পাক বাহিনীকে মোকাবিলা করতে লক্ষ্মীপুরের মুক্তিযোদ্ধারা লক্ষ্মীপুর শহরের মাদান ব্রিজ, চন্দ্রগঞ্জের বড় ব্রিজসহ বেশ কয়েকটি ব্রিজ মাইনের সাহায্যে উড়িয়ে দেয়।
লক্ষ্মীপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠে জানা যায়, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পুরো সময় জুড়ে লক্ষ্মীপুর জেলায় বর্বর পাকিস্তানি হানাদার ও এদেশীয় রাজাকার বাহিনী হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের ঘটনার মতো বর্বরতা চালায়। জেলা ও জেলার বাইরে অভিযান চালাতে গিয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জের প্রতাপগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়, মান্দারী বাজার, বড় মসজিদ, দালালবাজার এমপি উচ্চ বিদ্যালয়, রামগতির চর কলাকোপা, রায়পুর আলিয়া মাদ্রাসা, রামগঞ্জের কাঞ্চনপুর, লক্ষ্মীপুর শহরের বটু চৌধুরীর বাড়িসহ বেশ কয়েকটি স্থানে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে পাকবাহিনীর সদস্যরা তাণ্ডব চালায়।
অপরদিকে লক্ষ্মীপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের অপ্রতিরোধ্য গেরিলা যুদ্ধ তাদের জন্য আতঙ্কের কারণ ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে ৪ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুরের বাগবাড়ির মিলেশিয়া ক্যাম্প থেকে হানাদার বাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
জানা যায়, স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাসে লক্ষ্মীপুর-বেগমগঞ্জ সড়কে প্রতাপগঞ্জ হাইস্কুল, মান্দারী মসজিদ, মাদাম ঘাট ও বাগবাড়ি, লক্ষ্মীপুর-রামগঞ্জ সড়কে দালাল বাজার, কাজীর দিঘির পাড়, কাফিলাতলী, পানপাড়া, মিরগঞ্জ, পদ্মা বাজার, মঠের পুল এবং রামগঞ্জের হাইস্কুল সড়ক ও আঙ্গারপাড়া, লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়কে চর কলাকোপার দক্ষিণে জমিদার হাট সংলগ্ন, উত্তরে, করুণানগর, হাজির হাট, আলেকজান্ডার এবং রামগতি থানা ও ওয়াপদা বিল্ডিং এলাকা, রায়পুর আলীয়া মাদ্রাসা ও এল এল হাইস্কুল এলাকায় অধিকাংশ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এ সময় হাজার হাজার নিরীহ মানুষ এবং ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শীহদ হন। জেলায় মোট শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১১৪।
লক্ষ্মীপুর শহরের মাদাম ব্রিজ, বাগবাড়ি গণকবর, দালাল বাজার গার্লস হাইস্কুল, মডেল হাইস্কুল, মদিন উল্যা চৌধুরী (বটু চৌধুরী) বাড়ি, পিয়ারাপুর বাজার, মান্দারী মসজিদ ও প্রতাপগঞ্জ হাইস্কুল, রায়পুর আলীয়া মাদ্রাসা, এল এম হাইস্কুল ও ডাকাতিয়া নদীর ঘাট, রামগতির চর কলাকোপা মাদ্রাসা, ওয়াপদা বিল্ডিং, আলেকজান্ডার সিড গোডাউন, কমলনগরের হাজিরহাট মসজিদ, করইতলা ইউনিয়ন পরিষদ ভবন গোডাউন, রামগঞ্জ গোডাউন এলাকা, রামগঞ্জ সরকারি হাইস্কুল, জিন্নাহ হল (জিয়া মার্কেট) ও ডাক বাংলো ছিল হানাদার ও রাজাকার ক্যাম্প এবং গণহত্যার স্থান।
সূত্র জানায়, নভেম্বরের শেষের দিকে রায়পুর আলীয়া মাদ্রাসায় হানাদারদের ক্যাম্প আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধারা। কমান্ডার সুবেদার আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এখানে হানাদারদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিম বাসু শহীদ হন।
লক্ষ্মীপুরের প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কমান্ডার রফিকুল ইসলাম মাস্টারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ১ ডিসেম্বর মিলেশিয়াদের বাগবাড়ী ক্যাম্প অনেক দূর থেকে ঘেরাও শুরু করে। প্রবল গুলিবর্ষণ করতে করতে ওই ঘাঁটির রাজাকার ও হানাদারদের অবরুদ্ধ রেখে ৩ ডিসেম্বর ঘাঁটির খুব কাছাকাছি গিয়ে ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে অসহায় হয়ে যায় হানাদাররা। ৪ ডিসেম্বর ভোরে হানাদারদের দোসর রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে। এই সময় দুই শতাধিক রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দি হন।
মুক্তিযোদ্ধা ফিরোজ আলম ও আব্দুর রহিম বাসসকে জানান, যুদ্ধের নয় মাস লক্ষ্মীপুর শহরের বাগবাড়িস্থ বিশাল সারের গুদামটি ছিল মিলেশিয়াদের প্রধান ঘাঁটি ও টর্চার সেল। জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী স্থানীয় বাঙালিদের ধরে এনে এখানে অমানুষিক নির্যাতন করা হতো। পরে এদের ধরে রহমতখালী খালের ওপর মাদাম ব্রিজের ওপর থেকে গুলি করে হত্যা করে মরদেহ খালে ভাসিয়ে দেওয়া হতো। পরে মুক্তিসেনারা ওই ব্রিজটি বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়। ভগ্নদশা নিয়ে পরিত্যক্ত মাদাম ব্রিজটি মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের ক্ষত চিহ্ন ও স্মৃতি নিয়ে আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এ স্থানটি সংস্কার করা হয়নি।
এদিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা বিপুলসংখ্যক মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করে বাগবাড়ি টর্চার সেল সংলগ্ন একটি স্থানে পুঁতে রাখে। বর্তমানে সে স্থানটিকে গণকবর হিসেবে সংরক্ষিত করা হয়েছে।
জেলায় শহীদ ৩৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধারা হলেন; মনসুর আহমেদ, রবীন্দ্র কুমার সাহা, আলী আজম, লোকমান মিয়া, জয়নাল আবেদিন, মোহাম্মদ হোসেন, আবদুল বাকির, জহিরুল ইসলাম, আহাম্মদ উল্লাহ, আবদুল মতিন, মাজহারুল মনির সবুজ, চাঁদ মিয়া, নায়েক আবুল হাশেম, মো. মোস্তফা মিয়া, নুর মোহাম্মদ, রুহুল আমিন, আবুল খায়ের, আবদুল হাই, মোমিন উল্যা, আবু ছায়েদ, আব্দুল হালিম বাসু, এসএম কামাল, মিরাজ উল্ল্যা, মো. আতিক উলাহ, মো. মোস্তফা, ইসমাইল মিয়া, আবদুল্লাহ, আবুল খায়ের ভুতা, সাহাদুলা মেম্বার, আবুল কালাম, মোস্তাফিজুর রহমান, বেণু মজুমদার, আলী মোহাম্মদ, শহীদ নজরুল ইসলাম ও আবদুল রশিদ।
এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে অংশ নিয়ে লক্ষ্মীপুরের মোট ১১৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। হানাদার মুক্ত দিবস উপলক্ষে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এ উপলক্ষে আজ সকালে বাগবাড়ি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পার্ঘ্য প্রদান করা হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মতবিনিময়, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা এবং মসজিদ ও মন্দিরে দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।