ঢাকা, ৮ জানুয়ারি, ২০২২ (বাসস) : বিশ্বে প্রতি সাত সেকেন্ডে ১৫ বছরের কম বয়সী একটি কন্যাশিশুর বিয়ে হয়। বাংলাদেশে ১৮ বছরের আগে ৫৯ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়। ১৫ বছরের আগে বিয়ে হয় ২২ শতাংশ মেয়ের। ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের শতকরা ৩১ জন সন্তানসম্ভবা হয়। করোনা মহামারির মধ্য সারাদেশে বাল্যবিবাহের হার আরও অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
আইনজীবীদের মতে, অবশ্যই বাল্যবিয়েকে না বলতে হবে। পাশাপাশি বাল্যবিয়ে রোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। এরসঙ্গে যারাই জড়িত তাদের সবাইকে আইনের আওতায় এনে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কাজি, পুরোহিত এবং জনপ্রতিনিধিদেরও শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ভবিষ্যতে যারা বাল্যবিয়ের দাওয়াত খেতে যাবে তাদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই বাল্যবিবাহ বন্ধ সম্ভব হবে।
করোনা কালে বাল্যবিবাহ যে কতটা ভয়াবাহ রুপ নিয়েছে তা সারাদেশে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষায় অনুপন্থতি প্রমান করে। নাটোর জেলার বাগাতিপাড়ার একটি মহিলা মাদ্রাসার ১৫ জন ছাত্রীর ২০২১ সালে অনুষ্ঠিতব্য দাখিল পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোন ছাত্রী পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেনি। করোনাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ১৫ জনেরই বিয়ে হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে মাদ্রাসার সুপার আব্দুর রউফ জানান, তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে এ বছর ১৫ জন ছাত্রীর দাখিল পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কথা ছিল। তবে করোনার মহামারিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সময় সব ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। সে কারণেই কেউ পরীক্ষায় অংশ নেয়নি।
এই ঘটনা শুধু বাগাতিপাড়ায় নয়, এটা সারাদেশের চিত্র। বাল্যবিবাহের শিকার অনেক শিক্ষার্থী এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেনি। আবার অনেক স্থানে করোনাকালে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সময় যেসব মেয়ের বাল্যবিবাহ হয়েছিল শিক্ষকেরা অভিভাবকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুঝিয়ে তাদের পরীক্ষায় অংশ নেয়া নিশ্চিত করেছেন। এর মধ্য সন্তান জন্মের কয়েক ঘণ্টা, অনেকের একদিন-দুই পর পরীক্ষার হলে হাজির হওয়ার নজিরও রয়েছে।
খবর নিয়ে জানাগেছে, সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ের ৩৮ জন এসএসসি পরীক্ষার্থীর মধ্যে করোনাকালে ২২ জনের বাল্যবিবাহ হয়েছে। আশাশুনির বুধহাটা বালিকা বিদ্যালয়ের ছয়জন, নলতা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ১৫ জনের বাল্য বিবাহ হয়েছে।
এদিকে করোনাকালে খুলনায় তিন হাজারের বেশি ছাত্রী বাল্যবিবাহের শিকার হয়। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল এসএসসি পরীক্ষার্থী। জেলার রূপসা উপজেলার বেলফুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৭০ জন মেয়ের বাল্যবিবাহ হয়েছে।
জামালপুর পৌর শহরের বানিয়াবাজার উচ্চবিদ্যালয়ের নয়জনের বাল্যবিবাহ হয়েছে। এছাড়াও সদর উপজেলার আলীম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেনীর ৬১ জনের বাল্যবিয়ে হয়েছে। নেত্রকোনার খালিয়াজুরি উপজেলার দুটি বালিকা বিদ্যালয়ে ৩৫ জন ছাত্রীর বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের অনুসন্ধান অনুযায়ী, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যš Íদেশের ২১টিজেলার ৮৪ উপজেলায় ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিবাহ হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৬৫টি করে বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাল্যবিয়ে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় হারের দিক থেকে সর্বোচ্চ এবং বিশ্বে চতুর্থ।
ব্র্যাকের অনুসন্ধান অনুযায়ী, মহামারির কারণে ১৩ শতাংশ বাল্যবিবাহ আগের চেয়ে বেড়েছে এবং এটি গত ২৫ বছরে বাংলাদেশ বাল্যবিয়ের সর্বোচ্চ হার। ৬৮ শতাংশ বাল্যবিয়ে বন্ধ হয়েছে ২০২০ সালে প্রথম ১০ মাসে। ২০২০ এর মাচর্ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত যশোরের মণিরামপুর উপজেলার পাড়িয়ালি আদর্শ বালিকা দাখিল মাদ্রাসার ষষ্ঠ শ্রেণির দুজন, সপ্তমশ্রেণির চারজন, অষ্টম শ্রেণির ছয়জন, নবম শ্রেণির চারজন এবং দশম শ্রেণির চারজন বাল্যবিবয়ের স্বীকার হয়েছে। অন্যদিকে একই সময়ে ২০১৯ এর তুলনায় ৭২ শতাংশ বেশি বাল্যবিয়ে বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে।
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয়দেশগুলোর অন্যতম একটি। বাংলাদেশে ১৮ শতাংশ মেয়ের ১৫ বছর বয়সের মধ্যে বিয়ে হয়। ইউনিসেফের মতে, বর্তমানে বিশ্বে ৭০ কোটি মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার। এ ধারা চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা বেড়ে ৯৫ কোটিতে পৌঁছাতে পারে।
সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৫ বছরের কম বয়সী বিবাহিত মেয়েদের ২০ শতাংশ ২৪ বছর বয়স হওয়ার আগেই দুই বা ততোধিক সন্তানের মা হচ্ছেন। ফলে প্রসূতির মৃত্যুর হার এবং অপুষ্টিজনিত সমস্যা প্রকট হচ্ছে।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেল্থ সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, এক দশক ধরে বাংলাদেশে ৬৬ শতাংশ ক্ষেত্রে ১৯ বছর বয়সের আগেই বাল্যবিয়ের শিকার নারীরা অন্তঃসত্ত্বা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনজীবী মনিরুজ্জামান বলেন, সরকার বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে জাতীয়, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা এবং স্থানীয় পর্যায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তির সমন্বয়ে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে হবে। আমাদের মা-বাবাকে সচেতন হতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা ইন্দিরা বলেন, বাল্যবিয়ে এবং নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধ করতে সরকার বদ্ধপরিকর। নারীর ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে সরকারের রয়েছে জিরো টলারেন্স নীতি। কোনো মেয়ে যেনো বাল্য বিয়ের শিকার না হয়। সে লক্ষ্যে কাজ করতে হবে এবং সেক্ষেত্রে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।
তিনি বলেন, বাল্যবিয়ে বন্ধে সরকারের সব মন্ত্রণালয়-বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটিকে আরো উদ্যোগী হতে হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, ইমাম, ধর্মীয় নেতা, এনজিও প্রতিনিধি ও কমিউনিটি নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে বাল্য বিয়ে রোধ করতে হবে।