শিরোনাম

নারায়ণগঞ্জ, ১৫ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : সমাজে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে একঝাঁক বইপ্রেমিক ও স্বপ্নবাজ তরুণের হাত ধরে ১৯৬৪ সালে নারায়ণগঞ্জ শহরে যাত্রা শুরু করে ‘সুধীজন পাঠাগার’।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইতিহাসের ধারক কিংবা মানুষের জ্ঞান সংরক্ষণের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে পরিচিত বই। আর এই বইয়ের সুবিশাল ভাণ্ডারকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে পাঠাগার, যা মানুষকে পৃথিবীর বিচিত্র সব জ্ঞানের সান্নিধ্য দান করে। পাঠাগার এমন এক বাতিঘর, যেখানে নিত্যনতুন উপলব্ধি আর প্রজ্ঞায় নিজেকে বিকশিত করার সুযোগ মেলে।
তেমনই ১৯৬৪ সালে নারায়ণগঞ্জ শহরের আমলাপাড়া হরকান্ত ব্যনার্জী রোডের রজনী নিবাসের (রহমত উল্লাহ হাজীর মালিকানাধীন) একটি ছোট্ট ঘরে এই ‘সুধীজন পাঠাগার’র গোড়াপত্তন হয়।
অধ্যাপক নুরুল হক, ফজলে রাব্বী, হোসেন জামাল, শওকত আলী, সালাহ উদ্দিন আহমেদ ও শরীফ সারোয়ারসহ একঝাঁক উৎসাহী বইপ্রেমিক ও স্বপ্নবাজ তরুণের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় এই পাঠাগার।
আজ থেকে ৬ দশক আগে মাত্র ১০টি বই, একটি টেবিল, ছয়টি চেয়ার ও একটি আলমারি দিয়ে পাঠাগারটি যাত্রা শুরু করেছিল। অথচ সেই পাঠাগার যেন আজ এক মহীরুহ। এখানে থাকা কর্মচারীরা জানান, বর্তমানে সুধীজন পাঠাগারে ৫০ হাজারের বেশি বই রয়েছে, যার মধ্যে পাঠযোগ্য অবস্থায় আছে ৩০ হাজারের বেশি বই। সাহিত্য, ইতিহাস, জীবনীগ্রন্থ, বিশ্বকোষসহ নানা বইয়ে সমৃদ্ধ এই পাঠাগারটিতে ২৫ হাজার বাংলা, ৫ হাজার ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার বই রয়েছে। পাঠাগারের মোট সদস্য সংখ্যা ১০ হাজার হলেও, ১ হাজার ৫০০ জন পাঠক নিয়মিত এখানে আসেন।
প্রতিদিন দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত নানা বয়সী পাঠকদের পদচারণে মুখর থাকে এখানকার পাঠকক্ষ। কেউ পছন্দের বই খুঁজে নিয়ে সেখানেই পড়েন, কেউবা বই বাড়িতে নিয়ে যান, আবার কেউ চোখ বুলাতে থাকেন পত্রিকার পাতায়।
১৯৬৪ সালে আমলাপাড়ায় যাত্রা শুরুর পর ১৯৬৯ সালে পাঠাগারটি শহরের বিবি রোডের কো-অপারেটিভ ভবনে স্থানান্তরিত হয়। এরপর ১৯৭৮ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান প্রয়াত আলী আহম্মদ চুনকা এবং ঢাকা জেলা প্রশাসক এ.এম.এম শওকত আলীর সহযোগিতায় পৌরসভার একটি জমিতে লিজ পেয়ে নিজস্ব একতলা ভবনে স্থানান্তর হয় পাঠাগারটি। তবে স্থায়ী জায়গা পেলেও সংকট তখনো পুরোপুরি কাটেনি। এ.এম.এম শওকত আলী জেলা প্রশাসক থেকে পরবর্তীতে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে যোগদান করলে তিনি পাঠাগারের অবকাঠামো নির্মাণে এগিয়ে আসেন। তার সমর্থনে ব্যাংকটি পাঠাগারের নিচতলা ও দোতলার ৩ বছরের ভাড়া অগ্রিম প্রদান করে। সেই অর্থ দিয়েই ১৯৮৭ সালের ২৬ এপ্রিল তিনতলা ভবন নির্মাণ করে পাঠাগারটি তিনতলায় স্থাপন করা হয়। এরপর থেকে একাধিক মানুষের তত্ত্বাবধানে হাজারো পাঠক মননকে সমৃদ্ধ করতে পাঠাগারটি চলছে আপন গতিতে।
যে কোনো মানুষ এই পাঠাগারের সদস্য হতে পারেন। তবে সদস্য হতে শিক্ষার্থীদের বাৎসরিক ২৮৭ টাকা এবং সাধারণ মানুষকে বাৎসরিক ৩৪৭ টাকা চাঁদা পরিশোধ করতে হয়, যার মধ্যে এককালীন চাঁদা ২০০ টাকা। সদস্যদের বাইরেও প্রতিদিন অসংখ্য পাঠক এখানে এসে বিনামূল্যে পত্রিকা ও ম্যাগাজিন পড়ার সুযোগ পান।
পাঠাগারের নিয়মিত পাঠক মনির হোসেন বলেন, ‘নামমাত্র ফি দিয়ে এখানে সারা বছর পড়াশোনা করা যায়। একাডেমিক পড়ালেখার বাইরেও শিক্ষার্থীরা এখানে এসে পত্রিকা কিংবা বই পড়ে নিজের জ্ঞান পিপাসা মেটানোর সুযোগ পাচ্ছে। এই পাঠাগার নারায়ণগঞ্জবাসীর জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।’
শুধু বই পড়াই নয়, ‘সুধীজন পাঠাগার’ নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। পাঠাগার কর্তৃপক্ষ জানান, প্রতিবছর দেশের শিক্ষা বিষয়ক যে কোনো শাখায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য একজন গুণী ব্যক্তিকে ‘হোসেন জামাল স্মৃতি পুরস্কার’ (৫০ হাজার টাকা) প্রদান করা হয়। তাছাড়া শিক্ষা-সাহিত্য এবং সমাজ সেবায় অবদানের জন্য একজনকে ‘প্রফেসর নুরুল হক সাহিত্য পুরস্কার’ (১ লাখ টাকা) দেয়া হয়।
পাঠাগারের উদ্যোগে স্কুলে-স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের জন্য একাধিক শিক্ষামূলক ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। শুধু তাই নয়, নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধারণ করে পাঠাগারের উদ্যোগে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলো হলো- ১৯৮৫ সালের ২৬ মার্চ প্রকাশিত ‘নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস’, ১৯৯৪ সালে ড. করুণাময় গোস্বামীর সম্পাদনায় ও এ. কে. এম শামসুজ্জোহা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ‘বাংলা সংস্কৃতির শতবর্ষ’ এবং ২০০৫ সালে প্রকাশিত ‘অধ্যক্ষ খগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী’ স্মারক গ্রন্থ।
পাঠাগারের কর্মাধ্যক্ষ ইমতিয়াজ ফারুক মঈন বলেন, ‘কয়েক যুগ ধরে নারায়ণগঞ্জে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে সুধীজন পাঠাগার। এই লাইব্রেরির নান্দনিক পরিবেশের কারণে শিক্ষার্থীসহ সব শ্রেণীর পাঠকরা এখানে নিরিবিলি পড়াশোনা করতে পারেন।’
তিনি বলেন, ‘আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা অচিরেই একটি নিজস্ব ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপস চালু করতে যাচ্ছি। এর ফলে লাইব্রেরিতে উপস্থিত না হয়েও পাঠকরা বই সংক্রান্ত তথ্য ওয়েবসাইটে পেয়ে যাবেন।’
নারায়ণগঞ্জের প্রবীণ সাংবাদিক ও সাহিত্যিক অহিদুল হক খান এই পাঠাগার সম্পর্কে বলেন, ‘সুধীজন পাঠাগার অনেক সাহিত্যিকের জন্ম দিয়েছে। কবি, সাহিত্যিক ও পাঠকদের বইয়ের চাহিদা পূরণ করেছে। বই পড়ার কোন বিকল্প আমাদের নেই। এই শহরে নতুন প্রজন্মের সামনে বই তুলে ধরার অন্যতম গুরুদায়িত্ব পালন করেছে সুধীজন।’