বাসস
  ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ১৪:১৫
আপডেট : ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ১৬:৩৫

খাগড়াছড়ির পাড়াবন জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ‘রোল মডেল’ হতে পারে

খাগড়াছড়ির পাড়াবন। ছবি: বাসস

জীতেন বড়ুয়া 

খাগড়াছড়ি, ১৫ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : খাগড়াছড়ির পাড়াবন বা মৌজাবন জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এক ‘রোল মডেল’ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা। তাদের মতে, দেশের পার্বত্য জেলাসহ বনাঞ্চলে স্থানীয় বাসিন্দারা উদ্যোগী হলে দেশের জীববৈচিত্র্য ও বন সংরক্ষণ করা সহজ হবে। যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।  

জেলার দীঘিনালার পাবলাখালী মৌজায় প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করছেন স্থানীয় পাড়াবাসী। যেখানে অনেক জায়গায় বনজ সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে এই পাড়াবাসী ৭০০ একরের বেশি এলাকা জুড়ে গড়ে তুলেছেন এক অনন্য বন সংরক্ষণ উদ্যোগ। 

পার্বত্য চট্টগ্রামে একসময় প্রচুর বন, গাছগাছালি থাকলেও এখন আর তা নেই। প্রচুর গাছ কাটা ও বন উজাড় শুরু হয়েছে বহু আগে থেকে। তবুও অনেক এলাকায় গ্রামবাসী নিজেদের প্রচেষ্টায় কিছু বন রক্ষা করে চলেছেন। যাকে বলা হয় ভিলেজ কমন ফরেস্ট (ভিসিএফ) বা পাড়াবন বা মৌজা বন। যা একটি নির্দিষ্ট এলাকার গ্রামবাসীরা সংরক্ষণ করেন। তেমনি একটি বন হচ্ছে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা পাবলাখালী মৌজাবন।  যার আয়তন প্রায় ৭০০ একর। 

জীববৈচিত্র্য ও বন রক্ষায় ইউএনডিপির অর্থায়নে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সহায়তায় কাজ করছে এলাকাবাসী। এটি দেশের বন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটি ‘রোল মডেল’ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করে সহায়ক কর্তৃপক্ষ।

গ্রামবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, এই মৌজা বন থেকে গাছ ও বাঁশ কাটা এবং পশুপাখি শিকার করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কোনো ব্যক্তি চুরি করে গাছ বা বাঁশ কাটলে এবং পশুপাখি শিকার করলে তাকে গ্রামের আইন অনুযায়ী শাস্তি বা দণ্ড পেতে হবে। বন রক্ষায় তারা সরকারি-বেসরকারি সব সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা কামনা করেন।

তারা জানান, এই বনে রয়েছে ৬টি ছড়া ও অসংখ্য নালা। আছে গর্জন, গামাঢ়ী, সিভিট, লম্বু, তেলসুর, চাপালিশ, বন, জলপাই, উড়ি, আম, খুদে জাম, হরতকি, বহেরাসহ বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ। বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ, বন মোরগ, ভালুক, শূকর, ময়না, টিয়াসহ নানা প্রজাতির পাখির অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে এই বন। এসব বন রক্ষা করায় সুফল পাচ্ছেন তারা। বন আছে বলেই বনের পাশে ছড়া, নালাগুলোতে পানির প্রবাহ আছে। তাই জমি চাষাবাদ করাও সহজ হয়ে উঠেছে। এসব বন থেকে পানি আহরণ করেই এলাকার খাবার পানি সংরক্ষণ করা হয়। জানা যায়, খাগড়াছড়িতে এরকম আরও ৫৯টি পাড়াবন  বা মৌজা বন রয়েছে।

পাবলাখালী এলাকার বাসিন্দা অজিত বরন চাকমা জানান, এই বন শুধু পরিবেশ নয়, জীবন ও জীবিকার সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত। তারা প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা ও জীবনের প্রয়োজনের তাগিদে জীববৈচিত্র্য ও জলবায়ু রক্ষার জন্য কাজ করছে। আর এ প্রয়োজনের তাগিদ থেকেই খাগড়াছড়ি দীঘিনালার পাবলাখালী মৌজার প্রায় ৭০০ একর বন রক্ষায় কাজ করছে এলাকাবাসী।

খাগড়াছড়ির সাংবাদিক রূপায়ণ তালুকদার বলেন, বনের ভেতর ছড়া, ঝরনা আর গাছের পরিমাণ দেখে আমি সত্যিই অভিভূত। যেখানে মানুষ হাজার হাজার একর বনজঙ্গল কেটে ব্যক্তিগত লাভের জন্য ফলজ বাগান সৃজন করছেন, সেখানে দীঘিনালার পাবলাখালী পাড়াবাসীরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য জীববৈচিত্র্য ও জলবায়ু রক্ষায় বন সংরক্ষণের জন্য কাজ করছেন। এটি সত্যিই অনুকরণীয় ও প্রশংসাযোগ্য। 

তিনি বলেন, পাড়াবনে পাহাড়ি ছড়া ও ঝরনার পানি আশেপাশের কৃষিজমিতে সরবরাহ করায় পাহাড়ি জমিতে কৃষিকাজ করা সহজ হয়েছে। এলাকার বন রক্ষায়ও তারা কঠোর নিয়ম মেনে চলে। সারাদেশে বনাঞ্চলে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলে দেশের বন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বিপ্লব ঘটবে। তিনি এই উদ্যোগ সারাদেশের জন্য ‘রোল মডেল’ হতে পারে বলে উল্লেখ করেন।  

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের জনসংযোগ কর্মকর্তা চিংহ্লামং চৌধুরী বলেন, ৭০০ একর জুড়ে এই পাড়াবনে চারটি বড় বড় ছড়া ও অনেক গিরি-ঝিরি ও ঝরনা রয়েছে। এসব নালা, গিরি-ঝিরির পানির প্রবাহও খুবি আশাব্যঞ্জক। এখানে অনেক বিরল প্রজাতির মাতৃগাছ আছে। বন রক্ষায় সবাই এগিয়ে আসলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী তৈরি করা সম্ভব।

খাগড়াছড়ি বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. ফরিদ মিঞা বাসসকে বলেন, খাগড়াছড়ি জেলায় অনেকগুলো পাড়াবন আছে। এগুলো বায়োডাইভার্সিটি কনজারভেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। দীঘিনালা উপজেলার পাবলাখালী পাড়া বনটি খুবই সমৃদ্ধ এবং পাড়াবাসী ্এটা সংরক্ষণের জন্য আন্তরিক। সবার প্রচেষ্টায় পাড়াবনগুলো সংরক্ষিত হয়, পাবলাখালীরটাও এরকম। 

তিনি বলেন, এই পাড়াবনগুলো রক্ষার জন্য খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই বন রক্ষা করার জন্য যদি বন বিভাগের সহযোগিতা প্রয়োজন হয়, বন বিভাগ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।  

তবে দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের বন উজাড় হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে যে বন আছে তা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেন স্থানীয়রা। তারা জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সরকারি উদ্যোগে নতুন নতুন বন সৃষ্টি করার দাবি জানান।