বাসস
  ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:৩২

মেহেরপুরের দেড়শ বছরের ঐতিহ্য ‘সাবিত্রী ’ মিষ্টি

মেহেরপুরের দেড়শ বছরের ঐতিহ্য ‘সাবিত্রী ’ মিষ্টি। ছবি: বাসস

\ দিলরুবা খাতুন \

মেহেরপুর, ২৮ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : জেলার দেড়শ বছরের ঐতিহ্য ‘সাবিত্রী’ মিষ্টি। শুরু থেকে আজও পর্যন্ত স্বাদ ও মান ধরে রেখেছে ‘সাবিত্রী’ তৈরির কারিগর ও ব্যবসায়ীরা। দেখতে অনেকটা চমচমের মতো। তবে আকার লম্বা ও চ্যাপটা। খেতেও সুস্বাদু। 

এই মিষ্টির সুনাম দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও জায়গা করে নিয়েছে অনেক আগেই। এ অঞ্চলে বিয়ে বাড়ি কিংবা অতিথি আপ্যায়ন যেন এই মিষ্টি ছাড়া বেমানান। শুরু থেকে আজও পর্যন্ত ‘সাবিত্রী’ মিষ্টি তৈরির কারিগররা বংশ পরম্পরায় ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছেন। 

১৮৬১ সালে মেহেরপুর শহরের বড়বাজার এলাকার বাসুদেব সাহা নিজ বাড়িতে মিষ্টি তৈরি করে বিক্রি শুরু করেন। পৈতৃক পেশা হিসেবে তিনি মিষ্টির ব্যবসায় আসেন। দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এ মিষ্টি। স্থানীয় জমিদার ও ইংরেজদের কাছেও এ মিষ্টি প্রিয়তা লাভ করে।

সাবিত্রী মিষ্টির প্রথম কারিগর ছিলেন বাসুদেব সাহা। পরে মিষ্টি তৈরির এ বিদ্যাটি রপ্ত করেন তার ছেলে রবীন্দ্রনাথ সাহা। বাইরের কারিগর দিয়ে মিষ্টি তৈরির কাজ না করায় সাবিত্রীর গুণগত মান এবং স্বাদ আজও একই রকম। কদরও বাড়ছে দিন দিন। বাজারের অন্যান্য মিষ্টির তুলনায় এর দাম কম। সাধ্যের মধ্যে হওয়ায় সবাই এটি কিনে খেতে পারে।

জানা যায়, মিষ্টি বিক্রির টাকা দিয়েই চলত বাসুদেবের সংসার। খাঁটি ও নির্ভেজাল অর্থে সতী সাবিত্রীর নামেই বাসুদেব মিষ্টির নামকরণ করেন ‘সাবিত্রী’। সে সময় ভোজনরসিক জমিদারদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে এ মিষ্টি। কালক্রমে স্থানীয়দের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়ে দেশজুড়ে পরিচিতি লাভ করে। ধীরে ধীরে মেহেরপুরের ‘সাবিত্রী’ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও পরিচিতি পায়। 

স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বাড়িতে বিশেষ কোনো অতিথি আসলে তাদের নাস্তায় ‘সাবিত্রী’ মিষ্টি রাখাটা এ এলাকার রীতি। এ ছাড়াও আত্মীয়বাড়ি, ঘনিষ্ঠজনদের উপহার, বিয়ের অনুষ্ঠান ও নানারকম আয়োজনে এ মিষ্টি থাকবেই। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের অনুষ্ঠানগুলোতেও ‘সাবিত্রী’ মিষ্টি পরিবেশন যেন একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।  

তবে, বাজারে মিষ্টির কদর ও চাহিদা বাড়লেও পর্যাপ্ত দুধ ও জনবলের অভাবে এখন ৩০ থেকে ৪০ কেজির বেশি মিষ্টি তৈরি করা সম্ভব হয় না বলে জানান, সাবিত্রী মিষ্টির কারিগর ও ব্যবসায়ীরা। 

বাসুদেব গ্র্যান্ড সন্সের বর্তমান মালিক বিকাশ সাহা বলেন, ‘সাবিত্রী’ মিষ্টি তৈরিতে ব্যবহৃত দুধ কিংবা মিষ্টি ফ্রিজে রাখা হয় না। ফ্রিজে রাখলে স্বাদ আর মান ঠিক থাকে না। প্রতিদিন সংগ্রহ করা দুধ ভারী কাঠ দিয়ে চুলায় জ্বাল করানো হয়। দিনের পুরো সময় ধরে দুধ জ্বাল দিতে হয়। সন্ধ্যার দিকে জ্বাল দেওয়া শেষ হলে তা ঠান্ডা করার জন্য রেখে দেওয়া হয়। পরের দিন সকালে ‘সাবিত্রী’ বানিয়ে বিক্রি করা হয়। প্রতিদিন মিষ্টির যে পরিমাণ অর্ডার পাই, সে অনুযায়ী দুধের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। 

তিনি বলেন, ‘দুধ-চিনি আর কাঠের দাম বেড়ে যাওয়া এবং সময়মতো দুধের জোগান না পাওয়ায় মাঝে মাঝে সংকট তৈরি হয়। বাপ-দাদার হাতের মিষ্টি তৈরির স্বত্ব অন্য কাউকে দিতে চাই না। যদি কেউ ভেজাল করে, তাহলে দেড়শ বছরের সুনাম ক্ষুন্ন হবে। বিষয়টি মাথায় রেখেই বহিরাগত কাউকে কাজে নেওয়া হয় না।’

বিকাশ সাহা বলেন, আমরা ‘সাবিত্রী’ ও ‘রসকদম’ মিষ্টি তৈরি করে থাকি। দুটোই মেহেরপুরের ঐতিহ্য বহন করে। প্রতিকেজি ‘সাবিত্রী’ ও ‘রস কদম’ ৫৩০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। 

সাবিত্রী মিষ্টির নিয়মিত ক্রেতা মুরাদুর রহমান বাসসকে বলেন, আত্মীয়-স্বজনদের মুখ থেকে এ মিষ্টির কথা প্রথম শুনি। তখন থেকেই সাবিত্রী মিষ্টি কিনে নিজেরা খাই। আবার বিদেশেও আত্মীয়-স্বজনদের পাঠাতে হয়। 

মেহেরপুরের প্রবীণ সাংবাদিক ও লেখক তোজাম্মেল আযম বাসসকে বলেন, মেহেরপুরের ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরতে গেলে ‘সাবিত্রী’ মিষ্টির নাম চলে আসে। আমরা ছোট থেকেই এই মিষ্টির সাথে পরিচিত। ব্যবসায়ী ও কারিগরের হাত বদল হলেও জৌলুস আর সুনাম এখনো ধরে রেখেছেন কারিগররা।