শিরোনাম

ঢাকা, ২৪ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : জলবায়ু-সহনশীল পৌর অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনা জোরদার, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রকল্প ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের নির্বাচিত পৌরসভাগুলোতে জলবায়ু ও দুর্যোগ সহনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও নারীরা উপকৃত হচ্ছেন।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ‘দ্য কোস্টাল টাউনস এনভায়রনমেন্টাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রজেক্ট’ এর মাধ্যমে এ উন্নয়ন হয়েছে।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে শেষ হওয়া এই প্রকল্পের মাধ্যমে উপকূলীয় শহরগুলোতে জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকল্পটি পানি বাহিত রোগের হার ৭৬.৭ শতাংশে (২০১১ সালের ভিত্তিরেখা ৫০ শতাংশ) কমাতে সহায়ক হয়েছে এবং ২০২২ সালের জুনের মধ্যে ডায়রিয়া রোগী ভর্তি ২.১ শতাংশে (২০১১ সালের ভিত্তিরেখা ৯.০ শতাংশ ) নেমে এসেছে।
প্রকল্পটি জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে, যা বন্যা এবং অসুস্থতার দিন কমিয়ে কর্মঘণ্টা বৃদ্ধি করেছে এবং সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করেছে। এর ফলস্বরূপ, গড়ে পরিবারের আয় ৩০.৯ শতাংশ (প্রতি মাসে২০ হাজার ৬৮৫ টাকা) বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ২০১৩ সালের ছিল ১৫ শতাংশ (প্রতি মাসে ১৫ হাজার ৮০০ টাকা)।
মোট প্রকল্প ব্যয়ের ১০৩.৩৯ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে উন্নয়ন অংশীদাররা ৮৫.৯১ মিলিয়ন ডলার সরবরাহ করেছে। এতে রয়েছে এডিবির বিশেষ তহবিল ৪৪.৯৬ মিলিয়ন ডলার, গেটস ফাউন্ডেশনের ১.৪৫ মিলিয়ন ডলার, স্ট্র্যাটেজিক ক্লাইমেট ফান্ডের ২৬.৫৮ মিলিয়ন ডলার ঋণ ও ৮.৯১ মিলিয়ন ডলার অনুদান, ইউসিসিআরটিএফ-এর ৫.৪৮ মিলিয়ন ডলার এবং বাংলাদেশ সরকার বাকি ১৬.০১ মিলিয়ন ডলার প্রদান করেছে।
এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর হো ইউন জিয়ংয়ের সঙ্গে পটুয়াখালী পৌরসভায় প্রকল্পের সাইট পরিদর্শনকালে দেখা যায়, সিটিইআইপি প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের পর পটুয়াখালী পৌরসভাটি একটি জলবায়ু সহনশীল শহরে রূপান্তরিত হয়েছে। ঘন ঘন বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং তাপদাহের কারণে এটি একটি জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ছিল।
এডিবি কান্ট্রি ডিরেক্টরের পটুয়াখালী সফর উপলক্ষে পৌরসভা একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন পৌরসভার প্রশাসক (উপ-সচিব) জুয়েল রানা। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বরিশাল বিভাগে এলজিইডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শেখ মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম, এডিবির সিনিয়র প্রকল্প কর্মকর্তা এসএ আবদুল্লাহ আল মামুন এবং সিটিসিআরপির প্রকল্প পরিচালক মো. মোখলেসুর রহমান।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর বলেন, পটুয়াখালী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। ম্যানিলা-ভিত্তিক ঋণদানকারী সংস্থার (এডিবি) লক্ষ্য ছিল পটুয়াখালীকে একটি ‘জলবায়ু সহনশীল কেন্দ্র’ হিসেবে রূপান্তর করা।
হো ইউন জিয়ং বলেন, এডিবি’র সহযোগিতায় আমরা এটিকে একটি মডেল পৌরসভা হিসেবে রূপান্তরিত করতে চাই, যাতে অন্যান্য পৌরসভাগুলোও এটিকে অনুসরণ করতে পারে।
বাসসের সঙ্গে আলাপকালে স্থানীয় বিক্রেতা মিন্টু ও তার স্ত্রী লাইজু জানান, তারা প্রকল্পের আওতায় পুনর্নির্মিত রাস্তার পাশে ডাব বিক্রি করে ভালো আয় করছেন। তারা এখন প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা আয় করেন। বিশেষ করে বিকেলে প্রচুর মানুষ রাস্তায় ঘুরতে আসার কারণে তাদের এত পরিমাণ ডাব বিক্রি হয়।
প্রকল্পটির আওতায় পটুয়াখালী পৌরসভায় ৩৩.৩৩ কিলোমিটার সড়ক এবং ১২.২৫ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। সব অবকাঠামোই জলবায়ু সহনশীল নকশায় নির্মিত হয়েছে। সেখানে বিকল্প নির্মাণ উপকরণ, যেমন ইউনিব্লক দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে, যা পরিবেশবান্ধব এবং রক্ষণাবেক্ষণ সহজ। এটি ইট তৈরির দূষণ রোধ করে। বন্যার স্তরের উপরে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে এবং ৫০ বছরের দৃষ্টিকোণ থেকে নকশা করা হয়েছে।
পৌরসভার বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করার সময় দেখা গেছে, সাইকেল ও পথচারীদের জন্য পৃথক লেন রয়েছে। জলবায়ু-সহনশীল রাস্তা ও পথচারীদের জন্য নির্মিত অবকাঠামো যোগাযোগ ব্যবস্থায় গতিশীলতা এনেছে। এটি অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করছে এবং নারী ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিসহ সকলের জন্য পরিষেবাগুলোতে উন্নত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করেছে।
প্রকল্পের আওতায় পটুয়াখালী পৌরসভার জন্য একটি ড্রেনেজ সিস্টেমের মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয়েছে, যা পৌরসভা অনুমোদনও দিয়েছে। এর আওতায় মোট ১২ দশমিক ২৫ কিলোমিটার ড্রেন নির্মিত হয়েছে। বর্তমানে পৌরসভা নিজস্ব অর্থায়নে ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করছে।
উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা জলাবদ্ধতা ও বন্যার ঝুঁকি হ্রাসে সহায়তা করছে, জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটাচ্ছে এবং নগর পরিচ্ছন্নতা ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা জোরদার করছে। এতে ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে।
এছাড়া খননকৃত খাল ও পুকুরগুলো সারা বছর পানি ধরে রাখতে সহায়তা করছে, যা স্থানীয় তাপমাত্রা কমিয়ে দিচ্ছে। বন্যার সময় এগুলো অতিরিক্ত পানি ধারণ করতেও সক্ষম হচ্ছে, যা বন্যা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখছে।
প্রকল্পটি পটুয়াখালী পৌরসভার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাও বৃদ্ধি করেছে। এর ফলে রাজস্ব আদায়ের সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে, যেখানে আদায়ের হার ৯৫ শতাংশে পৌঁছেছে (লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী)। রাজস্ব বৃদ্ধি পৌরসভাকে নিয়মিত অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ করতে সহায়তা করছে।
সিটিইআইপি বাংলাদেশের আটটি জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় পৌরসভায় জলবায়ু সহনশীলতা এবং দুর্যোগ প্রস্তুতি শক্তিশালী করেছে। প্রকল্পটি নগর উন্নয়নে একটি সামগ্রিক ও সমন্বিত পদ্ধতি গ্রহণ করেছে।
এর মাধ্যমে জলবায়ু সহনশীল পৌর অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা এবং জনসচেতনতা জোরদার করা হয়েছে, যাতে জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে উন্নত নগর পরিকল্পনা ও সেবা প্রদান সম্ভব হয়।
প্রকল্পের আওতায় ড্রেনেজ, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, স্যানিটেশন, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রসহ অন্যান্য পৌর অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন করা হয়েছে। এছাড়া জরুরি সড়ক ও সেতু, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বাস টার্মিনাল, বস্তি উন্নয়ন, নৌঘাট ও বাজার উন্নয়ন করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) প্রকল্পের নির্বাহী সংস্থা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে এবং ১০টি পৌরসভা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে কাজ করেছে।
প্রকল্পটির উদ্ভাবনী নকশায় কর্মক্ষমতার ভিত্তিতে অর্থ বরাদ্দ ও পর্যায়ক্রমিক বাস্তবায়ন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। এতে প্রযুক্তিগত ও সম্প্রদায়ভিত্তিক দুর্বলতা মূল্যায়নের সমন্বয়ে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনকে মূলধারায় আনা হয়েছে।
জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো ও দুর্যোগ প্রস্তুতির ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ এবং ১০টি উপকূলীয় পৌরসভার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা জোরদারে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে সিটিইআইপি প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়।
এই পৌরসভাগুলো মূলত ১৫ হাজার থেকে ৬০ হাজার জনসংখ্যার দ্বিতীয় শ্রেণির শহর (মেট্রোপলিটান এলাকার বাইরে অবস্থিত) এবং জলবায়ুজনিত দুর্যোগের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ঝুঁকি বিবেচনায় বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ও সংযোগ সড়ক নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। নিরাপদ পানির অপ্রতুলতা, অতিরিক্ত লবণাক্ততা, অনিরাপদ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন এবং অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন সুবিধা প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত হয়।
এছাড়া উপকূলীয় পৌরসভাগুলোর ব্যবস্থাপনা দুর্বল ও অভিযোজন সক্ষমতা কম ছিল। কারণ অনেক পৌরসভায় জনসম্পৃক্ততার জন্য প্রতিষ্ঠিত কাঠামো অনুপস্থিত ছিল এবং বাজেট বরাদ্দ সীমিত ছিল। এর ফলে কর আদায়ের দক্ষতা কমে যায় এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা পুরোনো পদ্ধতিনির্ভর হয়ে পড়ে। এর মধ্যে কম্পিউটারভিত্তিক হিসাবরক্ষণ ও বিলিং ব্যবস্থা সীমিত ছিল। ফলে অধিকাংশ পৌরসভা কম রাজস্ব ও তহবিল সংকটে ভুগছিল।