বাসস
  ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ১৮:৪০

ওনিয়ন ব্লোয়ার মেশিন ব্যবহারে ফরিদপুরে পেঁয়াজের ঘাটতি মিটবে শতভাগ

ছবি : বাসস

ফরিদপুর, ১৬ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : পেঁয়াজ সংরক্ষণ ও কম খরচে স্থাপনযোগ্য ওনিয়ন ব্লোয়ার মেশিন ফরিদপুরের কৃষকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ মেশিনের ক্রমাগত ব্যবহার এবং গুনগত মান ভালো হওয়ায় বিদেশ থেকে ভালো মানের যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে জেলায় গড়ে তুলছেন এ ওনিয়ন ব্লোয়ার তৈরির কারখানা। আর কৃষক ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভালো ফল পাওয়ায় পেঁয়াজ সংরক্ষণের নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। তারা মনে করেন, এ মেশিনের ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে দেশের পেঁয়াজের শতভাগ ঘাটতি মেটানো সম্ভব। আর এতে বাঁচবে বৈদেশিক মুদ্রা।

কৃষি সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, এবছর ফরিদপুরে ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে সংরক্ষণযোগ্য হালি পেঁয়াজ আবাদ করে ছয় লক্ষাধিক মেট্রিকটন পেঁয়াজ উৎপাদন করা হয়েছে। 

কৃষকদের দাবি, উৎপাদিত পেঁয়াজ সংরক্ষণের কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিপছরই বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে কমমূল্যে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন কৃষকেরা। ফলে বাধ্য হয়েই সরকারকে প্রতি বছরই পেঁয়াজ আমদানি করতে হয় বিভিন্ন দেশ থেকে। এই পদ্ধতিতে অল্প জায়গায় অনেক বেশি পেঁয়াজ ৮-৯ মাস পর্যন্ত পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যায়, পেঁয়াজের রংও ভালো থাকে।

তারা আরও জানান, প্রতি বছর দেশের চাহিদা ২৮ লাখ মেট্রিকটন, কিন্তু দেশে ৩৬ লাখ মেট্রিকটন পেঁয়াজ উৎপাদন হলেও শুধুমাত্র সংরক্ষণের অভাবে পঁচে যাওয়ায় প্রতি বছর প্রায় পাঁচ থেকে ছয় লাখ মেট্রিকটন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয় সরকারকে। এতে খরচ হয় বৈদেশিক মুদ্রা।

ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার চর মুরারদিয়া গ্রামের আব্দুল আজিজ, মধুখালী উপজেলার জাহাপুরের নিখিল দাসসহ জেলার আরও কয়েকজন কৃষক বলছেন, আকার ভেদে ব্লোয়ার মেশিনে দুইশ থেকে তিনশ মন পর্যন্ত পেয়াজ সংরক্ষণ করা যায়। এতে পেঁয়াজ নষ্ট হয়না, শুধু শুকিয়ে সাত থেকে ১০ শতাংশ কমে। 

অন্যদিকে প্রচলিত নিয়মে সংরক্ষণ করলে ১০ শতাংশ শুকিয়ে কমে যাওয়ার পাশাপাশি আরো অন্তত ৩০ শতাংশ পেঁয়াজ পঁচে নষ্ট হয়ে যায়। 

এছাড়া স্থাপন খরচও একদিকে কম হয়, অন্যদিকে আট থেকে নয় মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। এ প্রযুক্তির স্থাপন ব্যায় নাগালের মধ্যে থাকাসহ নানা সুবিধা বিবেচনায় নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ব্লোয়ার মেশিন ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছেন কৃষকেরা। অভাবনীয় সুফল পাওয়ায় একে অন্যের দেখাদেখি প্রতিনিয়ত এই মেশিনের ব্যবহার বাড়াচ্ছেন তারা।

এদিকে কৃষক ও পেঁয়াজ সংরক্ষকদের কাছ থেকে আশাতীত সাড়া পেয়ে সর্বোচ্চ গুনগত মানের মেশিন উৎপাদন ও সরবরাহ করে ব্যবসায়িক সুনাম সৃষ্টি করতে চান প্রস্তুতকারীরা। 

নিউ শাপলা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ এর স্বত্বাধিকারী দুর্গা প্রসাদ সাহা জানান, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানসম্মত কাঁচামাল ও চায়না থেকে মানসম্পন্ন ফ্যান আমদানী করে আন্তর্জাতিক ভুট্টা ও গম উন্নয়ন কেন্দ্র এর সিসা-ম্যাকানাইজেশন প্রোগ্রাম এর গবেষনালব্দ প্রযুক্তিতে প্রতিটি মেশিন তৈরি করছেন তারা। যা বাজারে প্রতিটি ধারণ ক্ষমতা অনুসারে ১৮ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। সেই সাথে থাকছে ১০ বছরের বিক্রয়ত্ত সেবা। তিনি আরো জানান, ২০২৩ সালে প্রথমে ১৫ টি মেশিন তৈরি করি, ২০২৪ সালে ১২৫টি এবং ২০২৫ সালে সরাসরি কৃষকদের মাঝে ৩৫০ টি ও কৃষি অফিসের প্রণোদনা প্রোগ্রামের মাধ্যমে আরো ৬০০ টি মেশিন তৈরি ও সরবরাহ করি। এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ও আমার ব্যবসার প্রসার ঘটেছে।

কৃষি বিশেষজ্ঞরা আরো জানিয়েছেন, কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় মেশিনের গুণগত মান ঠিক রাখতে প্রস্ততকারীদের সাথে কাজ করছে আন্তর্জাতিক ভুট্টা ও গম উন্নয়ন কেন্দ্র (সিমিট ঈওগগণঞ) এর সিসা-ম্যাকানাইজেশন ((wmwgU CIMMYT) (CSISA-MEA)  তারা জেলার ১০টি কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মানসম্পন্ন পন্য তৈরির উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক ও শ্রমিকদের মেশিনের মান নিয়ন্ত্রন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ শ্রমিক তৈরির মাধ্যমে দ্রুত এ শিল্পের বিকাশে কাজ করছেন।

কৃষি উন্নয়ন কর্মকর্তা, কৃষিবিদ জসিম উদ্দিন জানান, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড তাদের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের মাধ্যমে পেঁয়াজ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনুধাবন করেন যে, কৃষকদের মূল সমস্যা হল যথাযথ সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড পেঁয়াজের নতুন এয়ার ফ্লো মেশিন উদ্ভাবন করেন এবং ফরিদপুর অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করেন। পরবর্তীতে ২০২২ সাল থেকে আন্তর্জাতিক ভুট্টা ও গম উন্নয়ন কেন্দ্র সিমিট-বাংলাদেশ (CIMMYT-BANGLADESH) তাদের সিসা-মেকানাইজেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের কারিগরি ও বাজারজাতকরণে সহায়তা প্রদান করে স্থানীয়ভাবে পেঁয়াজের এয়ার ফ্লো মেশিন তৈরি করে। 

প্রচলিত পদ্ধতিতে কৃষকের বসত ঘরে টিনের চালের নীচে, বাঁশের মাচায় পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা হয় বিধায় উচ্চ তাপমাত্রা, অধিক আর্দ্রতা, ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ ইত্যাদি কারণে সংরক্ষিত পেঁয়াজ প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। এতে পেঁয়াজের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি ৩০-৪০ শতাংশ থেকে ১০-১৫ শতাংশে নামিয়ে নিয়ে আসে। কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সিমিটের কারিগরি সহযোগিতায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ফরিদপুর অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে এ প্রযুক্তির সম্প্রসারণে কাজ করছে।

সিমিট-বাংলাদেশ (CIMMYT-Bangladesh),  যশোর অঞ্চলের আঞ্চলিক সমন্বয়ক কৃষিবিদ মো. জাকারিয়া হাসান জানান, দেশ জুড়ে এ মেশিন ব্যবহারের মাধ্য প্রতি বছর পঁচে যাওয়া ১০ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ রক্ষা করা গেলে সংকটের কারণে আমদানি করতে হবেনা। তাদের দাবি, প্রতি বছর পঁচে যাওয়া অংশকে রোধ করা গেলে, অন্তত আরো ১০ লাখ টন পেঁয়াজ ব্যবহারযোগ্য থাকবে। এতে প্রতি বছর আমদানির ছয় থেকে আট লাখ টনের ঘাটতি মিটিয়ে আরো অন্তত দুই থেকে তিন লাখ টন উদ্বৃত্ত থাকবে, যা রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

তিনি বলেন, পেঁয়াজ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এই এয়ার ফ্লো মেশিন একটি যুগান্তকারী প্রযুক্তি, যা পেঁয়াজের সংগ্রোহোত্তর ক্ষতি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে এবং কৃষকরা ৮-৯ মাস ধরে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে পারে। 

এটি কৃষকদের জন্য একটি সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা। তিনি আরও বলেন, স্থানীয় প্রস্তুতারকদের মাধ্যমে মেশিন তৈরি ও কৃষকদের মাঝে গুনগত মানসম্পন্ন মেশিন সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সিমিট- বাংলাদেশ ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর একযোগে কাজ করছে। কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় ক্ষুদ্র ও প্রন্তিক কৃষকদের মধ্যে ফরিদপুরে সাতশটি ও রাজবাড়িতে পাঁচশটি এয়ার ফ্লো মেশিনসহ আরো ৫০০ টি মেশিন বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া জলবায়ু অভিযোজন প্রকল্পের মাধ্যমে আরও কয়েকশ মেশিন বিতরণের কার্যক্রম চলছে।

কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, লাগসই এই প্রযুক্তি প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে সম্প্রসারণ করা গেলে একদিকে যেমন পেঁয়াজ আমদানী করতে হবেনা। অন্যদিকে লাভবান হবেন কৃষকেরাও, নিশ্চিত হবে ন্যায্য মূল্য।