বাসস
  ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ১৫:৩৫

কুমিল্লায় সবজির চারা উৎপাদনে সাড়া জাগিয়েছে সমেষপুর

কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার সমেষপুর গ্রামে সবজির চারা উৎপাদনে ব্যস্ত কৃষকেরা। ছবি: বাসস

দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ

কুমিল্লা, ১৪ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : গোমতী নদীর অববাহিকায় বেলে দোআঁশ মাটির উর্বর কুমিল্লা অঞ্চল। চার যুগেরও বেশি সময় ধরে এখানকার মাটি, পানি ও পরিশ্রমী মানুষের ঘামে জন্ম নিচ্ছে নানা প্রজাতির সবজির চারা। এক সময়ের ক্ষুদ্র পেশা আজ রূপ নিয়েছে কোটি টাকার শিল্পে। গেল বছরের বন্যা ও বৈরী আবহাওয়ার ধাক্কা সামলে এ বছর পুনরায় ঘুরে দাঁড়িয়েছেন চারাচাষিরা। তাদের হাতে গড়ে উঠছে শীতকালীন সবজির নতুন মৌসুমের আশাব্যঞ্জক স্বপ্ন। এদিক থেকে এগিয়ে গেছে সমেষপুর গ্রাম।

সম্প্রতি কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার সমেষপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ভোর থেকেই জমিতে কর্মচাঞ্চল্য। কেউ জমি প্রস্তুত করছেন, কেউ বীজতলায় পানি দিচ্ছেন, কেউবা চারা তুলে আঁটি করছেন। পাশে দাঁড়িয়ে পাইকারেরা গুনে গুনে চারা বুঝে নিচ্ছেন। প্রতিদিন এমন দৃশ্য দেখা যায় এ অঞ্চলে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে কুমিল্লা জেলায় প্রায় ২০ হেক্টর জমিতে ৭০০-এর বেশি কৃষক চারা উৎপাদনে যুক্ত রয়েছেন। এতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। শুধু সমেষপুর নয়, ডাকলাপাড়া, কালাকচুয়া, কাবিলা ও নিমসার এলাকায়ও বড় আকারে চারা উৎপাদন হচ্ছে। এ ছাড়া চান্দিনা, দেবিদ্বার, বরুড়া, চৌদ্দগ্রামসহ বিভিন্ন উপজেলায়ও চারা উৎপাদন ও বিক্রির কর্মকাণ্ড চলছে।

জেলা কৃষি কর্মকর্তাদের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি মৌসুমে এসব চারার বাজারমূল্য দাঁড়ায় ২০ থেকে ২২ কোটি টাকার মতো। মান ভালো হওয়ায় কুমিল্লার চারা সুনাম কুড়িয়েছে সারাদেশে। এখানকার উৎপাদিত টমেটো, মরিচ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, কুমড়াসহ বিভিন্ন সবজির চারা চলে যাচ্ছে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, হবিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকাসহ দেশের নানা জেলায়।

দেবিদ্বার উপজেলার হামলাবাড়ি এলাকার কৃষক তোরাব আলী জানান, গত বছর বন্যায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছিল। এবার আগেভাগেই সবজি চাষ শুরু করার পরিকল্পনা নিয়েছেন তিনি। তাই তিনি চারা সংগ্রহ করতে এসেছেন সমেষপুরে।

তিনি বলেন, ভালো জাতের চারা সবসময় এখানেই পাওয়া যায়। তাই প্রতিবছরই আসি। এবারও আগের মতো ভালো চারা নিয়ে মাঠে নামব।

সমেষপুরের বিখ্যাত সাথী-বিথী নার্সারির মালিক মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, তার পরিবারের এ ব্যবসার ইতিহাস প্রায় চার দশকের।

তিনি বলেন, প্রথমে আমার বাবা ইউসুফ আলী ব্রিটিশ আমলের পর থেকে এ গ্রামে চারা উৎপাদন শুরু করেন। পরে অন্যদের উৎসাহিত করলে পুরো এলাকাই এখন চারা ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে। আমি ৪০ বছর ধরে এ পেশায় আছি। সমেষপুরের ভালো চারার ঐতিহ্য কয়েক যুগের। গুণগত মান ভালো হওয়ায় দেশের সব জায়গায় আমাদের চারা বিক্রি হয়। এই এলাকা থেকেই বছরে সাত কোটি টাকার মতো চারা বিক্রি হয়।

আরেক ব্যবসায়ী মদিনা নার্সারির স্বত্বাধিকারী মো. সাইফুল ইসলাম জানান, শ্রাবণ থেকে কার্তিক পর্যন্ত চার মাস থাকে মূল উৎপাদন মৌসুম। গেলবার অতিবৃষ্টি ও বন্যায় বড় ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। এবার ক্ষতি কাটিয়ে পুরোদমে চারা উৎপাদন ও বেচাবিক্রি শুরু করেছি। কৃষকরাও চারা নিচ্ছেন।

বুড়িচং উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আফরিনা আক্তার বলেন, চারা উৎপাদনে নিয়োজিত কৃষকদের আমরা নিয়মিত কারিগরি পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়ে থাকি। উৎপাদন বৃদ্ধি ও গুণগত মান বজায় রাখতে উপজেলা কৃষি অফিসের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও চলছে। এবার ঘন ঘন বৃষ্টিপাতের কারণে প্রাথমিকভাবে কিছু ক্ষতির আশঙ্কা থাকলেও আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে মৌসুম শেষে ভালো ফলনের আশা করা যাচ্ছে।

কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, চারা উৎপাদনে কুমিল্লা দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় জেলা হিসেবে পরিচিত। এখানকার কৃষকেরা বহুদিন ধরে মানসম্মত সবজির চারা উৎপাদন করে সারাদেশের বাজারে সরবরাহ করছেন। আমরা কৃষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ, বীজ নির্বাচন, পোকামাকড় দমন এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়ে সার্বিক কারিগরি সহায়তা প্রদান করে থাকি।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে জেলার প্রায় ২০ হেক্টর জমিতে সাত শতাধিক কৃষক চারা উৎপাদনে যুক্ত রয়েছেন। চলতি মৌসুমে এই খাতে প্রায় ২০ কোটি টাকার বেশি বেচাকেনা হতে পারে বলে আশা করা যাচ্ছে। চারা উৎপাদনের এই সাফল্য ভবিষ্যতে জাতীয় পর্যায়ে সবজি উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এ জন্য চারাচাষিদের আরও দক্ষ ও সক্ষম করে তুলতে উন্নত প্রশিক্ষণ ও সহায়তা কার্যক্রম জোরদারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।