বাসস
  ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ১৩:৪৫

বিএফআরআইয়ের উদ্ভাবনে ফিরছে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মাছ

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)। ছবি: বাসস

।। মো. সাকিব আল তানিউল করিম জীম।।

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ১৪ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস): বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) দেশের মৎস্যখাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে। বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় প্রজাতি পুনরুদ্ধার থেকে শুরু করে নতুন জাত উদ্ভাবন, সীউইড ও কুঁচিয়া চাষের প্রযুক্তি উন্নয়ন সব ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানটি সাফল্যের নতুন অধ্যায় রচনা করে চলেছে।

১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত বিএফআরআই বর্তমানে দেশের একমাত্র জাতীয় মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। সদর দপ্তর ময়মনসিংহে অবস্থিত এই ইনস্টিটিউটের অধীনে চাঁদপুর, খুলনা, কক্সবাজার, বাগেরহাট ও রাঙামাটিতে রয়েছে বিশেষায়িত গবেষণা কেন্দ্র।

মহাশোল মাছের ব্রুড উন্নয়ন ও প্রজনন, দেশীয় প্রজাতির সংরক্ষণ, গুড়া চিংড়ি চাষ, কৈ মাছের প্রজনন প্রযুক্তি, কুঁচিয়া মাছের ব্রিডিং এবং পরিবেশবান্ধব বটম ক্লিন ইউনিট প্রকল্পসহ নানা গবেষণা বর্তমানে চলমান। এসব উদ্যোগ শুধু মৎস্য উৎপাদন নয়, বরং দেশের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

বিএফআরআই-এর নিরলস গবেষণায় এখন পর্যন্ত ১৮টিরও বেশি বিপন্ন মাছের প্রজাতি সফলভাবে পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে টেংরা, পাবদা, গুলশা, শিং, মাগুর, মহাশোল ও কুচিয়া। এসব প্রজাতির জিন ভাণ্ডার সংরক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেছে অত্যাধুনিক ‘লাইভ জিন ব্যাংক’। এ জিন ব্যাংক ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দেশীয় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে নতুন আশার আলো জ্বালিয়েছে।

জেনেটিক গবেষণার মাধ্যমে বিএফআরআই উদ্ভাবন করেছে উন্নত জাতের রুই মাছ ‘সুবর্ণ রুই’। যা প্রচলিত জাতের তুলনায় ১৬ থেকে ২০ শতাংশ বেশি উৎপাদন সক্ষম। পাশাপাশি উদ্ভাবন করেছে কৈ মাছের রোগ প্রতিরোধী ভ্যাকসিন, কুঁচিয়ার কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তি এবং ‘মেকানিক্যাল ফিশ ড্রায়ার’। এর মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে নিরাপদ ও মানসম্মত শুঁটকি মাছ। এছাড়াও রয়েছে মুক্তা গবেষণা কেন্দ্র এবং মৎস্য জাদুঘর। 

জাতীয় মাছ ইলিশের টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করতে বিএফআরআই ‘স্ট্রেনদেনিং অব হিলসা রিসার্চ’ প্রকল্প পরিচালনা করছে। চাঁদপুর নদী গবেষণা কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে নতুন অভয়াশ্রম নির্ধারণ ও জাটকা সংরক্ষণে ইতোমধ্যে দৃশ্যমান সফলতা এসেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব উদ্যোগের ফলে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ।

উপকূলীয় অঞ্চলে নোনা টেংরা, পারশে, কাঁকড়া ও সীউইড চাষে বৈপ্লবিক সাফল্য অর্জন করেছে বিএফআরআই। কক্সবাজার ও টেকনাফ উপকূলে পরীক্ষামূলক সীউইড চাষে প্রতি বর্গমিটারে ১ কেজিরও বেশি উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি পার্বত্য জেলায় চলছে কুচিয়া চাষ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ প্রকল্প। যা পাহাড়ি অঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে।

গবেষকদের মতে, মেকং নদীর বিশাল আকারের ‘জায়ান্ট পাঙ্গাস’ বর্তমানে বিএফআরআইতে সফলভাবে বড় হচ্ছে। এ মাছের গড় ওজন ১২০-১৪০ কেজি হলেও কিছু ব্রুড ২০০ কেজিরও বেশি। গবেষকরা আশা করছেন, দেশে এই প্রজাতির নিজস্ব ব্রুড তৈরি সম্ভব হলে তা মৎস্য খাতে এক নতুন বিপ্লব বয়ে আনবে।

বিএফআরআই-এর উদ্ভাবিত ৮০টিরও বেশি প্রযুক্তি দেশের মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরাসরি ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট কৃষিজ উৎপাদনের ৩.৬১ শতাংশ আসে মৎস্য খাত থেকে। যেখানে বিএফআরআই-এর গবেষণা ও প্রযুক্তি অন্যতম অবলম্বন।

প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক ড. অনুরাধা ভদ্র বাসসকে বলেন, আমাদের লক্ষ্য শুধু মাছ উৎপাদন নয়, বরং টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ নিশ্চিত করা। দেশের জলসম্পদ আমাদের ভবিষ্যৎ। তাই গবেষণার পরিধি আরও বাড়ানো হচ্ছে।

বিএফআরআই-এর চলমান গবেষণা, উদ্ভাবন ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি দেশের মৎস্যসম্পদ ব্যবস্থাপনাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের নীল অর্থনীতি বাস্তবায়নের অন্যতম ভিত্তি এখন বিএফআরআই। যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি-১৪) অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।