শিরোনাম
কুষ্টিয়া, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : ‘খাজা নিবেন খাজা, কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজা, মজার রাজা কুষ্টিয়ার তিলের খাজা’। দেশের প্রায় সব বাসস্ট্যান্ড, রেল স্টেশন এমনকি বিভিন্ন হাটে-ঘাটে-বাজারে হকারদের এমন হাঁকডাক সকলের কাছেই পরিচিত। চিনি ও তিলের মিশ্রণে সম্পূর্ণ হাতে তৈরি কুষ্টিয়ার তিলের খাজা খেতে দারুণ সুস্বাদু।
ক্রেতা আকৃষ্ট করতে নানা রকম হাঁকডাকের মাধ্যমে রেলওয়ে স্টেশন, বাসটার্মিনাল, লঞ্চঘাটসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হতে দেখা যায় কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজা। এর জনপ্রিয়তা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও পৌঁছেছে, দিন দিন বাড়ছে আন্তর্জাতিক চাহিদা।
সঠিক তথ্য না থাকলেও স্থানীয়দের দাবী প্রায় ১৫০ বছরের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের ধারক-বাহক এই তিলের খাজা। সম্প্রতি তিলের খাজা ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে। লালন ফকিরের মাজারের পার্শ্ববর্তী কারখানাগুলো হওয়ায় স্থানীয় বাউল সাধুদের দাবি প্রায় ১৫০ বছর আগে ফকির লালন সাঁই তিলের খাজা নিয়ে একটি গান রচনা করেছিলেন। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া না গেলেও জনশ্রুতি থেকেই তিলের খাজা নিয়ে এমন গান চলে আসছে বছরের পর বছর।
তিলের খাজার কারিগররা জানান, এর প্রস্তুত প্রক্রিয়া বেশ কষ্টসাধ্য। চিনি ও দুধ জ্বাল দিয়ে নির্দিষ্ট ঘনত্ব তৈরি হলে হালকা ঠান্ডায় জমাট বেঁধে চিনির মণ্ড তৈরি হয়। সেই মণ্ড গাছ বা বাঁশের সঙ্গে বিশেষভাবে টাঙিয়ে হাতে টানা হয়। মণ্ডটি হালকা বাদামি থেকে সাদা রঙে পরিণত হলেই কারিগর তাঁর নিপুণ হাতের টানে ভেতরের অংশ ফাঁপা করেন। পরে বিছিয়ে রেখে তা নির্দিষ্ট মাপে কাটা হয়। ওই কাটা অংশের ওপর খোসা ছাড়ানো তিল ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর করা হয় প্যাকেটজাত। এভাবেই তৈরি হয় তিলের খাজা।
কুষ্টিয়ার কারখানা দুটিতে প্রতি রাতে প্রায় আড়াইশ কেজি করে তিলের খাজা তৈরি হয়। যা ভোর হওয়ার সাথে খুচরা এবং পাইকারি বিক্রেতাদের মাধ্যমে চলে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সম্প্রতি এটি ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, যা এর সাংস্কৃতিক ও আঞ্চলিক গুরুত্বকে আরও দৃঢ় করেছে।
কুষ্টিয়ার দুটি প্রধান কারখানায় প্রতিদিন রাতে প্রায় ২৫০ কেজি তিলের খাজা তৈরি হয়, যা ভোরেই দেশের বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজারে পৌঁছে যায়।
তবে খ্যাতি থাকলেও শিল্পটি নানা সমস্যায় জর্জরিত। এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক অনটন আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে এই শিল্প। বিভিন্ন সময়ে নান প্রতিকুলতার প্রভাব এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি এই ব্যাবসায়ীরা। এরমধ্যে কাঁচা মালের দাম বেড়ে যাওয়ায় সব মিলিয়ে চরম মানবেতর জীবন যাপন করছেন এই পেশার মানুষ।
একসময় খাজার অধিকাংশ কারখানা ছিল চৌরিয়ার লালন আঁখড়া বাড়ির আশপাশে। এখন হাতে গোনা কয়েকটি রয়ে গেছে, যেগুলোর ইতিহাস ৫০ বছরেরও বেশি। তবে বাড়তি চাহিদার কারণে বিভিন্ন জেলায় নতুন কারখানা গড়ে উঠছে।
কারিগররা জানান, আগে শুধুমাত্র শীতকালেই মৌসুমি খাবার হিসেবে তিলের খাজা তৈরি হতো। এখন সারা বছরই উৎপাদন হয়- রাতে তৈরি, দিনে বিক্রি। শীতের মৌসুমে প্রায় টানা ২৪ ঘণ্টা কারখানা সচল থাকে।
জিআই স্বীকৃতি পেলেও খাজা এখনও ক্ষুদ্রশিল্পের পর্যায়েই রয়ে গেছে এবং পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা ও বিনিয়োগের অভাবে টিকে থাকার লড়াই করছে।
কুষ্টিয়া রেলস্টেশনে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তিলের খাজা বিক্রি করে আসা ফেরিওয়ালা রতন ঘোষ বলেন, ‘আমরা গর্বিত যে সারা বাংলাদেশ কুষ্টিয়াকে তিলের খাজার জন্য চেনে। কিন্তু সত্যি কথা হলো, আমদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। খরচ বাড়ছে, অথচ সহায়তা আসছে না। সরকার যদি আমাদের সহযোগিতা করে, এই সুস্বাদু খাজাই সারা বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচয় বহন করতে পারে।’