শিরোনাম
বরিশাল, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : ‘অন্ধকারে হারানো স্বপ্নে আলো ছড়াক, প্রতিটি শিশুর চোখে জ্বলে উঠুক শিক্ষার বাতি’ এমন শ্লোগান নিয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সংলগ্ন এলাকায় পথচলা শুরু করে স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষার্থী সংগঠন ‘বাতিঘর’।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের কয়েকজন উদ্যমী শিক্ষার্থীর হাত ধরে সূচনা হয় এ সংগঠনের। এর উদ্যোক্তা আশা মণি, সহ-সংগঠক উম্মে সেরাতুন্নেছা, হিছরতুন্নাহক নেহা, মিথিলা ফারজানা কেয়া ও আরও ছয়জন তরুণ শিক্ষার্থীর নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় যাত্রা শুরু করে এটি।
মূলত নদীনির্ভর জীবনযাপনকারী মান্তা সম্প্রদায়ের, বিশেষ করে তাদের নারী ও শিশুদের পাশে দাঁড়ানোই ছিল বাতিঘরের উদ্দেশ্য। বর্তমানে বরিশাল সদর উপজেলার কর্নকাঠি গ্রামের আমিন কলোনি সংলগ্ন এলাকায় প্রায় ৪০ জন মান্তা শিশু বাতিঘরের সদস্যদের কাছ থেকে সাক্ষরতা শিক্ষা পাচ্ছে।
এদের অনেকেই আগে কখনো স্কুলে যায়নি বা হাতে বই ধরেনি। এখন বাতিঘর তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে শিক্ষার উপকরণ। শুধু শিশু নয়, দারিদ্র্য ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে যেসব মান্তা নারী পড়াশোনা মাঝপথে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, তারাও বাতিঘরের শ্রেণিকক্ষে নতুন করে শিক্ষা গ্রহণ করছেন।
সহ-সংগঠক উম্মে সেরাতুন্নেছা বলেন, ‘আমাদের স্বপ্ন খুব সহজ, কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ: টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার চতুর্থ লক্ষ্য পূরণ করা, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা। যেন কোনো শিশু বা নারী অশিক্ষার অন্ধকারে পড়ে না থাকে। শিক্ষার এই আলোই তাদের বৈষম্যমুক্ত করবে এবং নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে।’
শিক্ষাকে একঘেয়ে বইনির্ভর না করে আনন্দময় করতে বাতিঘর আয়োজন করছে গান, কবিতা আবৃত্তি ও নাটকের। ফলে শিশুরা কেবল পড়াশোনা করছে না, সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে আত্মবিশ্বাসও অর্জন করছে।
শুধু শিক্ষা নয়, শিশুদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতাতেও নজর দিচ্ছে বাতিঘর। সদস্যরা পরিবার ও অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। আগে দারিদ্র্য ও অজ্ঞতার কারণে শিশুরা অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হতো। এখন অভিভাবক পরামর্শ কার্যক্রমের মাধ্যমে পরিবারগুলো সচেতন হচ্ছে এবং সন্তানদের স্নেহ ও যত্নে বড় করার অঙ্গীকার করছে। এভাবেই শিশু ও নারীদের সামাজিক মূলধারায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে সংগঠনটি।
সহ-সংগঠক হিছরতুন্নাহক নেহা ও মিথিলা ফারজানা কেয়া বলেন, ‘মান্তা সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্যের শিকার। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা বঞ্চিত। আমরা এই বৈষম্যের দেয়াল ভাঙতে চাই। আমাদের উদ্দেশ্য হলো, মান্তা জনগোষ্ঠীও যেন সমাজের অন্য সবার মতো সমান সুযোগ পায়।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগসহ অন্যান্য বিভাগের শিক্ষকরা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন। তারা দিকনির্দেশনা ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে বাতিঘরের কার্যক্রম সচল রাখতে সহযোগিতা করছেন। তাদের সহায়তায় শিশুদের বিনা মূল্যে বই, খাতা, কলম ও অন্যান্য শিক্ষাসামগ্রী দেওয়া হচ্ছে।
উদ্যোক্তা আশা মণি বলেন, ‘আমরা একটি সমতার পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখি। এজন্য সমাজের প্রতিটি শ্রেণি-পেশার মানুষকে মূলধারায় আসতে হবে। রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধ থেকেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সমাজে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছি। ভবিষ্যতে আমরা এ কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করতে চাই।’
বাতিঘরের আলো এখনো ছোট একটি শিখা, কিন্তু এই শিখাই বড় হয়ে ছড়িয়ে দিতে পারে সমতার স্বপ্ন, শিক্ষার উপহার আর একটি মানবিক পৃথিবীর অঙ্গীকার।