বাসস
  ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:৫৬
আপডেট : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৩:১৬

শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের নির্দেশে জুলাই গণহত্যা : সাবেক আইজিপি 

ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। কোলাজ: বাসস

ঢাকা, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫(বাসস) : চব্বিশের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দমনে সরাসরি লেথাল উইপন (মারণাস্ত্র) ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ শেখ হাসিনাসহ তিন জনের বিরুদ্ধে মামলায় গতকাল রাজসাক্ষী হিসেবে দেয়া জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এ কথা বলেন।

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকেও আসামি করা হয়। গত ১০ জুলাই তিনি এ মামলায় দোষ স্বীকার করে নিয়ে অ্যাপ্রুভার (রাজসাক্ষী) হওয়ার আবেদন করেন ট্রাইব্যুনালে। তার আবেদন মঞ্জুর করা হয়।  মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে দেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এই প্রথম কোনো আসামি অপরাধ স্বীকার করে ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হিসেবে জবানবন্দি দেন।

জবানবন্দিতে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মাধ্যমে গত বছরের ১৮ জুলাই শেখ হাসিনার ওই নির্দেশনা পেয়েছিলেন তিনি। সেদিন থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে মারণাস্ত্র ব্যবহার শুরু হয়েছিল। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের নির্দেশে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে।

গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ শুরু হলে সাক্ষীরা যেখানে জবানবন্দি দেন, সেখানে তাকে নেওয়া হয়। এরপর তিনি জবানবন্দি দেওয়া শুরু করেন।

ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে আন্দোলন নির্মূলে আসা নির্দেশের বিষয়টি জবানবন্দিতে তুলে ধরেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি বলেন, গত বছরের ১৮ জুলাই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান তাকে ফোন করে জানান, আন্দোলন দমনে সরাসরি ‘লেথাল উইপন’ ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তখন তিনি পুলিশ সদর দপ্তরে ছিলেন। ওই সময় তার সামনে উপস্থিত থাকা পুলিশ কর্মকর্তাদের নামও উল্লেখ করেন সাক্ষ্যে। ওই দিন থেকেই মারণাস্ত্র ব্যবহার শুরু হয়।

জবানবন্দিতে চৌধুরী মামুন বলেন, মারণাস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে অতি উৎসাহী ছিলেন ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর ও ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নির্দেশ ছিল, যেকোনো মূল্যে আন্দোলন দমন করতে হবে।

সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট সকালে তিনি পুলিশ সদর দপ্তরের নিজ কার্যালয়ে যান। ইতোমধ্যে উত্তরা, যাত্রাবাড়ী এবং বিভিন্ন পথ দিয়ে স্রোতের মতো ছাত্র-জনতা ঢাকা শহরে প্রবেশ করতে শুরু করে। সেদিন দুপুর ১২টা থেকে ১টার মধ্যে তিনি জানতে পারেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন।

ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনা কোথায় যাবেন, তা জানতেন না বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন তিনি। 

তিনি আরো বলেন, চব্বিশের ৫ আগস্ট বিকেলে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার এসে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে তাদের প্রথম তেজগাঁও বিমানবন্দরে এবং সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্টের অফিসার্স মেসে নিয়ে যায়। এ সময় তার সঙ্গে হেলিকপ্টারে করে ক্যান্টনমেন্টে যান তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার, এসবির প্রধান ও আমেনা বেগম (তৎকালীন ডিআইজি)। তার পরের পালায় তৎকালীন অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার, অতিরিক্ত ডিআইজি লুৎফুল কবিরসহ অন্যদেরও ক্যান্টনমেন্টে নেওয়া হয় হেলিকপ্টারে করে। পরে গত বছরের ৬ আগস্ট আইজিপি হিসেবে তার চুক্তি বাতিল করা হয় বলে জানান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। 

তিনি বলেন, ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানকালীন তাকে গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয়।

জবানবন্দিতে চৌধুরী মামুন বলেন, সমন্বয়কদের আটকের দায়িত্ব পান ডিবির হারুন। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই থেকে প্রায় প্রতি রাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ধানমন্ডির বাসায় ‘কোর’ কমিটির বৈঠক হতো। বৈঠকে আন্দোলন দমনসহ সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হতো। কমিটির একটি বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের আটক করার সিদ্ধান্ত হয়। ডিজিএফআই এই প্রস্তাব দেয়। তিনি এর বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে তিনি রাজি হন। আটকের দায়িত্ব তৎকালীন ডিবিপ্রধান হারুনকে দেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত মোতাবেক ডিজিএফআই ও ডিবি তাদের আটক করে ডিবি হেফাজতে নিয়ে আসে।

জবানবন্দিতে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, সমন্বয়কদের ডিবি হেফাজতে এনে আন্দোলনের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আপস করার জন্য চাপ দেওয়া হয়। তাদের আত্মীয়স্বজনকেও ডিবিতে এনে চাপ দেওয়া হয়। সমন্বয়কদের আন্দোলন প্রত্যাহার করে টেলিভিশনে বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয়। এ ব্যাপারে তৎকালীন ডিবিপ্রধান হারুন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ডিবির তৎকালীন প্রধান হারুনকে ‘জিন’ বলে ডাকতেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

জবানবন্দিতে গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত অপরাধের দায় স্বীকার করেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। প্রত্যেক শহীদের পরিবার, আহত ব্যক্তি, দেশবাসী ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা চেয়ে তিনি বলেন, ‘আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দেবেন।’

জবানবন্দিতে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, তিনি সাড়ে ৩৬ বছর পুলিশে চাকরি করেছেন। সব সময় পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। কিন্তু তার চাকরিজীবনে কখনো কোনো অভিযোগ আসেনি। চাকরিজীবনের শেষ পর্যায়ে তার দায়িত্বকালে এত বড় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। এর দায় তিনি স্বীকার করছেন। তিনি বলেন, ‘আমার এই সত্য ও পূর্ণ বর্ণনার মাধ্যমে সত্য উদ্ঘাটিত হলে আল্লাহ যদি আমাকে আরও হায়াত দান করেন, বাকিটা জীবন কিছুটা হলেও অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাব।’

বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ুএ গতকাল সাক্ষ্য দিয়েছেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

জবানবন্দির পর ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, সিদ্ধান্তগুলো রাষ্ট্রের কোন জায়গা থেকে, কীভাবে এসেছে, নির্দেশনা আসার পদ্ধতিগুলো কী ছিল, বাস্তবায়ন ধাপে ধাপে কীভাবে হয়েছে, কোন ‘কমান্ড স্ট্রাকচার’ কীভাবে কাজ করেছে-এসব তথ্য সাবেক আইজিপি ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরেছেন।

চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, এটি একটি অকাট্য ও অপ্রতিরোধ্য সাক্ষ্য। চব্বিশের জুলাই-আগস্ট শুধু নয়, গত ১৫-১৬ বছরে দেশে গুম-খুনসহ যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে, সে বিষয়ে একটি অকাট্য দলিল তিনি ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেছেন।

ট্রাইব্যুনালে এই মামলায় প্রসিকিউসন পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এসএইচ তামিম শুনানি করেন। একসময় অপর প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন। এদিকে এই মামলায় পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। আর এই মামলায় গ্রেফতার হয়ে পরে রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।

মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। একপর্যায়ে এই মামলায় দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদঘাটনে (অ্যাপ্রোভার) রাজসাক্ষী হতে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের আবেদন মঞ্জুর করেন ট্র্যাইব্যুনাল।

এ মামলায় গতকাল ১১ তম দিনে মামুন ৩৬ তম সাক্ষীর সাক্ষ্য দেন। এর আগে আরও ৩৫ জনের সাক্ষ্য ও জেরা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

এটি ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরও দুটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। অন্য মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়।

গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দমনে আওয়ামী লীগ সরকার, এর দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে বলে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে। দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসব অপরাধের বিচার কাজ এখন চলছে।