শিরোনাম
।। জীতেন বড়ুয়া।।
খাগড়াছড়ি, ২৬ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : নিয়মিত অভিযান, মামলা, জরিমানা আদায় ও গ্রেফতার করা হলেও পাহাড় খেকোদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না খাগড়াছড়ির পাহাড়গুলো। পরিবেশ আইন অমান্য করে দেদারসে চলছে পাহাড় কাটা।
জেলা সদরের জেলা পরিষদের হর্টিকালচার পার্কের পাশে উপজাতীয় কর্মকর্তা হাউজিং সমিতির প্রবেশের মুখে অবৈধভাবে পাহাড় কাটার কারণে পাহাড়টি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এতে করে যেকোনো মুহূর্তে পাহাড়টি ধসে পড়লে খাগড়াছড়ি- চট্টগ্রাম-ফেনী-ঢাকার সাথে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বেআইনিভাবে পাহাড় কাটার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্যও।
স্থানীয়রা জানান, প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রকাশ্যে ও রাতের আঁধারে কাটা হয় পাহাড়। পাহাড় কেটে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলা হচ্ছে। কখনো প্রকাশ্যে কখনো রাতের আঁধারে পাহাড়ের মাটি কেটে অন্যত্র বিক্রি করা হচ্ছে। আবার কেউ কেউ পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করছেন। প্রশাসন মাঝে মাঝে অভিযান চালিয়ে পাহাড় কাটার দায়ে জরিমানা ও জেল দিলেও থামছে না পাহাড় কাটা। এভাবে পাহাড় কাটার কারণে বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন পবিরেশবাদীরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, খাগড়াছড়ি জেলা সদরের জেলা পরিষদ পার্ক, গঞ্জপাড়া, পৌর শহরের সবুজবাগ, উত্তর সবুজবাগ, শালবন, কুমিল্লা টিলা, মাইচছড়ি, দীঘিনালার বোয়ালখালী, বন বিহার সংলগ্ন এলাকা, মাটিরাঙা, গুইমারা, মানিকছড়ির বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় কাটা হচ্ছে। মূলত পাহাড় কেটে বাড়ি নির্মাণের পাশাপাশি বিভিন্ন বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের জেলা পরিষদ পার্ক।
এলাকার উপজাতীয় কর্মকর্তা হাউজিং সোসাইটির বাসিন্দা বিপাশা দেওয়ান বলেন, একটি প্রভাবশালী মহল প্রকাশ্যে স্ক্যাভেটর দিয়ে হাউজিং এর পাহাড়টি কেটে বাণিজ্যিক প্লট তৈরি করছে। একই অভিযোগ করেছেন এ পাহাড়ের কিছু অংশের মালিক মো. ইছাক । এতে করে উপজাতীয় কর্মকর্তা হাউজিং সোসাইটির পাহাড়টি বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ।
দীঘিনালার বোয়ালখালী মৌজার হেডম্যান ত্রিদীপ রায় বাসসকে বলেন, একটি চক্র আইনের তোয়াক্কা না করে দেদারসে পাহাড় কেটে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে কর্তন করা পাহাড় ধসে পড়ছে।
প্রকাশ্যে পাহাড় কাটার পাশাপাশি অনেকে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে রাতের আঁধারেও পাহাড় কাটছে।
জায়গা ভরাট, বাড়ি নির্মাণ, রাস্তা সংস্কার, ইটভাটাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্য পাহাড় কাটছে একটি চক্র।
পাহাড়ের মাটি কেটে ট্রাকে নিয়ে যাচ্ছে পাহাড় খেকোরা। বিভিন্ন উপজেলায় প্রকাশ্যে বা রাতের আঁধারে পাহাড়ের মাটি কেটে অন্যত্র বিক্রি করা হচ্ছে। সস্তা ও সহজলভ্য হওয়ায় বেআইনিভাবে চলছে পাহাড় কাটা।
স্থানীয়রা জানান, পাহাড় কাটা বন্ধে প্রশাসন অভিযান চালালে কয়েকদিন বন্ধ থাকে। তারপর আবারও শুরু হয় পাহাড় কাটা। জেলার দীঘিনালা, মাটিরাঙ্গা, রামগড়, গুইমারা ও খাগড়াছড়ি জেলা সদরে সবচেয়ে বেশি পাহাড় কাটা চলছে।
এদিকে পাহাড় কাটা বন্ধে প্রশাসন জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলেও পাহাড়ে তা মানা হচ্ছে না। প্রচলিত আইন অমান্য করে পাহাড় কাটায় ক্ষোভ জানান পরিবেশবাদীরা।
খাগড়াছড়ির পিটাছড়া বন ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতা মাহফুজ রাসেল বলেন, ‘অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটার কারণে বর্ষায় পার্বত্য এ জেলায় বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসে। প্রশাসনিকভাবে পাহাড় কাটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় এ অপতৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। অবিলম্বে তাদের অপতৎপরতা বন্ধ করা না গেলে ভয়াবহ পরিবেশ ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে। তিনি উন্নয়নের নামে পাহাড় না কেটে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের অনুরোধ জানান ।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ ইনামুল হাছান বাসসকে বলেন, ইতোমধ্যে পাহাড় কর্তনের দায়ে জরিমানা আদায় করা হয়েছে। এ ছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরের মাধ্যমে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। যারা পাহাড় কাটবে তাদের বিরুদ্ধে আগামীতেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর খাগড়াছড়ির সহকারী পরিচালক হাসান আহমেদ বলেন, পাহাড় কাটা বন্ধে জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি পরিবেশ অধিদপ্তরও কাজ শুরু করেছে। অবৈধভাবে পাহাড় ও টিলা কাটার ঘটনায় সম্প্রতি পাঁচটি মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। দুটি ঘটনায় আদায় করা হয়েছে পরিবেশগত ক্ষতিপূরণ।
তিনি বলেন, পরিবেশ আইন লঙ্ঘনের দায়ে অল্প সময়ের ব্যবধানে খাগড়াছড়িতে এত সংখ্যক মামলার ঘটনা এবারই প্রথম। পাহাড় কাটার অভিযোগে একজনকে জেলও দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা বন্ধে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হবে।
হাসান আহমেদ আরো বলেন, কয়েক বছর থেকে খাগড়াছড়িতে পরিবেশ অধিদপ্তরের নিজস্ব কার্যালয় খোলা হয়েছে। এরপর থেকে পাহাড় কাটার অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করেছি।
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার বাসসকে বলেন, পাহাড় কাটার ঘটনায় একাধিক ব্যক্তিকে জরিমানা করেছে জেলা প্রশাসন। বিভিন্ন সময়ে পাহাড় কাটার কাজে ব্যবহৃত স্ক্যাভেটরও জব্দ করা হয়েছে। পাহাড় কাটার ব্যাপারে বর্তমান প্রশাসন জিরো ট্রলারেন্স অবস্থানে আছে।
তিনি বলেন, নিয়ম না মেনে পাহাড় কাটার সুযোগ নেই। প্রচলিত আইন অমান্য করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও জানান, অবৈধভাবে পাহাড় কাটার দায়ে জেলা প্রশাসন জেলার ২০টি স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদের দণ্ডসহ ৫০ লক্ষ টাকা জরিমানা আদায় করেছে । তবে চলতি মৌসুমে খাগড়াছড়িতে অসংখ্য পাহাড় কেটে সাবাড় করে ফেলা হয়েছে।