শিরোনাম
তানভীর হায়াত খান
নেত্রকোণা, ৯ আগস্ট ২০২৫ (বাসস): সময়মতো পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ায় চলতি রোপা আমন মৌসুমে খুশি জেলার ধান চাষিরা। তারা এখন আমন ধানের জমি প্রস্তুত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। গত একসপ্তাহ ধরে নিয়মিত বৃষ্টি হওয়ায় অনেকটাই স্বস্তিতে আছেন তারা। চলতি মৌসুমে আমনের অধিক ফলন হবে বলে আশা করছেন তারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বীজতলায় আমন ধানের চারা বড় হওয়ার সাথে সাথে তা রোপণ করার জন্যে জমি প্রস্তুত রাখতে হয়। এজন্য জমিতে পর্যাপ্ত পানি দরকার হয়। আমন মৌসুমে প্রাকৃতিক বৃষ্টির উপর নির্ভর করে ধান চাষ করা হয়। এতে সেচ খরচ থেকে রেহাই পান কৃষক। গত এক সপ্তাহের বৃষ্টিতে কৃষি জমিতে পর্যাপ্ত পানি জমা হওয়ায় কৃষকদের মনে এনে দিয়েছে স্বস্তি।
সরেজমিনে জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, কৃষকরা কোথাও ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ করাচ্ছেন। কেউ আগাছা পরিষ্কার করছেন। আবার অনেকে সম্পূর্ণ ক্ষেত প্রস্তুত করে রোপণ করছেন আমন ধানের চারা। নেত্রকোণায় এসব চারাকে বলে ‘জালা’। আমন ধানের এসব বীজতলাকে স্থানীয়ভাবে জালা পাট বলা হয়। কৃষকেরা এসব জালা পাট থেকে চারা উঠিয়ে ধানক্ষেতে মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছেন। আবার কোথাও দলবদ্ধ হয়ে সে আমন ধানের জালা বা চারা রোপণ করছেন। কোথাও ধানক্ষেতের আইলে বসে কৃষকেরা দুপুরের খাবার খাচ্ছেন।
জেলার ১০ টি উপজেলার মধ্যে ৬ টি উপজেলা হাওর অধ্যুষিত। বর্ষার এ সময়ে হাওরাঞ্চলের বেশিরভাগ জমিই পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে। ফলে এসব হাওর উপজেলার বিশাল পরিমাণ জমিতে ধান চাষ করা সম্ভব হয় না। তাই এই আমন ধান চাষ জেলার ধান ও চালের যোগানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ মৌসুমে সেচের খরচ না থাকলেও রয়েছে কৃষি কাজে সম্পৃক্ত শ্রমিকের সংকট। এখন আগের মতো কৃষি শ্রমিক পাওয়া যায় না। ফলে অন্যান্য কাজে সম্পৃক্ত শ্রমিকদের বেশি টাকা মজুরি দিতে হয়। কাঠা প্রতি চারশত থেকে পাঁচশত টাকা মজুরি দিতে হয়। আবার দৈনিক মজুরি নির্ধারণ করে কাজ করাতে হয়। কৃষিতে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন গৃহপালিত পশু গরু, মহিষ দিয়ে হালচাষ করার প্রবণতাও কমেছে। গরু দিয়ে হালচাষ খুবই কম দেখা যায়। কম সময়ে বেশি জমি প্রস্তত করার জন্যে কৃষকেরা এখন ট্রাক্টর ব্যবহার করেন। বেশিরভাগ কৃষকেরই নিজস্ব ট্রাক্টর না থাকায় তারা কাঠাপ্রতি একটি নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে অন্যের ট্রাক্টর দিয়ে নিজের জমি চাষ করান।
সরেজমিনে দেখা যায়, দেশি ধানের পরিবর্তে এখন হাইব্রিড জাতের ধান চাষে বেশি আগ্রহী কৃষকেরা। বিভিন্ন দেশি ধান যেমন সকালপুরি, রথিশাইল, বিরুই, পায়জাম, নাজিরশাইল, লয়াটাং ইত্যাদি আমন ধান একসময় এ অঞ্চলে বেশিরভাগ চাষ করা হতো। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এখন হাইব্রিড জাতের ধান এসব দেশি জাতের ধানের জায়গা দখল করেছে। বিআর-৪৯, বিআর-৩২, বিআর ৭, বিআর-১৭, বিআর ৩৪, জিরা বাদাম, সুমনা, ধানিগৌড়সহ বিভিন্ন হাইব্রিড জাতের ধান এখন বেশি চাষ করা হয়।
জেলার সদর উপজেলার মেদনী ইউনিয়নের পশ্চিম উলুয়াটি গ্রামের কৃষক আব্দুল মোতালিব খান জানান, তিনি এ বছর প্রায় ৪০ কাঠা জমিতে আমন ধানের চাষ করবেন। ইতোমধ্যে ১৫ কাঠা জমিতে আমন ধানের চারা রোপণ করেছেন। সেচের পানি নিয়ে যে দুশ্চিন্তা ছিল গত এক সপ্তাহের বৃষ্টিতে তা অনেকটা কমে গেছে। তিনি আশা করছেন এ বছর ভালো ফসল পাবেন। তবে বীজ ধান, সার, কীটনাশকের দাম ও কৃষি শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় ধান চাষের খরচ বেড়ে গেছে বলে তিনি জানান।
একই গ্রামের কৃষক আব্দুর রহিম খান বাসসকে বলেন, সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচের টাকা বাদ দিয়ে কাঠা প্রতি ধান উৎপাদন করে তেমন লাভ হয় না। অনেক সময় খরচের পরিমাণ আর উৎপাদিত ধানের বাজারমূল্য প্রায় সমান হয়ে যায়। ফলে ধান চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষক। সহজ শর্তে কৃষিঋণ, প্রণোদনা, বীজ ও সার সহজলভ্য করা হলে কৃষকরা ধান চাষে আরো আগ্রহী হবেন।
জেলার বারহাট্টা উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের লামাপাড়া গ্রামের কৃষক আব্দুর রশিদ জানান, তিনি এ বছর ৪ একর জমিতে আমন ধানের চাষ করবেন। তিনি উচ্চ ফলনশীল বিআর-৩২, পাইজাম, ভারতি পাঞ্জা প্রভৃতি ধান রোপণ করবেন। হঠাৎ করে বন্যা বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় না হলে এবছর ভালো ফসল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
জেলার দুই পাহাড়ি ও সীমান্তবর্তী উপজেলা দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা। এই দুই উপজেলায় রয়েছে ঢলের পানিতে ফসল নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা এবং বন্য হাতির লোকালয়ে চলে এসে ফসলের ক্ষতি করার প্রবণতা। তাই এই দুই উপজেলার কৃষকদের এ মৌসুমে সতর্কতা ও কৌশল অবলম্বন করতে হয়।
দুর্গাপুর ও কলমাকান্দায় এখন আমন ধান চাষের বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। সীমান্ত গ্রামের আদিবাসী ও বাঙালি কৃষকরা আমন ধানের চারা রোপণে ব্যস্ত সময় পার করছেন ।
সীমান্ত গ্রামের কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ঢলের পানিতে ক্ষতির আশঙ্কা ও লোকালয়ে হাতির আক্রমণের শঙ্কা থেকেই এবার আগেভাগেই চলছে আমন ধানের চাষাবাদ। কৃষি বিভাগ কৃষকদের বিনা ধান ১৭ ও ১৮ জাতের স্বল্প জীবনকালীন ধান আবাদে উদ্বুদ্ধ করছে। এতে আগাম রোপা আমনের পর কৃষকেরা অন্যান্য ফসল আবাদ করতে পারেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ নুরুজ্জামান বলেন, ‘ নেত্রকোণা জেলায় এ বছর ১ লাখ ৩৫ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে রোপা আমন আবাদ করা হয়েছে। এ জমিতে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ২৫ হাজার ৮৯৫ মেট্রিক টন। ইতোমধ্যে আমাদের এ জেলায় ১৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আবাদ সম্পন্ন হয়েছে। অবশিষ্ট জমিতে আবাদ কার্যক্রম চলছে।
তিনি বলেন, কৃষকরা যাতে সুষম পরিমাণে সার ব্যবহার করে রোপা আমন আবাদ করতে পারেন এজন্যে ডিলার পর্যায়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে সারের মজুদ রয়েছে। আমরা আশা করছি, আমাদের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ জমিতে ধান আবাদ সম্ভব হবে।
কৃষিবিদ নুরুজ্জামান বলেন, নেত্রকোণা জেলায় ৬ টি উপজেলায় হাওরের অধীনে জমি আছে প্রায় ৪৪ হাজার হেক্টর। এগুলো এখন পানির নিচে। এ অবস্থায় আমাদের তেমন কিছু করার সুযোগ নেই। তবে হাওরের পানি কমে যাওয়ার পরে যাতে কৃষকগণ বাড়তি ফসল উৎপাদন করতে পারেন সেজন্যে আমরা তাদের আগাম রবি ফসলসহ বিশেষ করে সরিষা আবাদের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে থাকি। আমাদের এ জেলায় সরিষা আবাদ বিগত তিন বছরে প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এবছর আমাদের লক্ষ্যমাত্রা বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। পানি সরে যাওয়ার পর দ্রুত যাতে কৃষক ভাইয়েরা তাদের জমিতে আগাম রবি ফসল চাষ করে লাভবান হতে পারে এবং পরবর্তী বোরো ফসল যেন নির্বিঘ্নে আবাদ করতে পারে এজন্য আমরা তাদের পরামর্শসহ বিভিন্ন সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি।