শিরোনাম
এনামুল হক এনা
পটুয়াখালী, ২৩ জুলাই ২০২৫ (বাসস) : উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীতে দিন দিন বাড়ছে মানুষ, বাড়ছে নতুন নতুন বাড়িঘর। অন্যদিকে জেলার বুড়াগৌরাঙ্গ ও তেঁতুলিয়া নদীর অব্যাহত ভাঙনে কমছে চাষের জমি।
দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ থাকলেও সচেতনতার অভাবে দশমিনা উপজেলায় জন্ম নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি। এখনও দুর্গম চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কার আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে রেখেছে। ফলে প্রতিবছর লোকসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে চাষের জমি দখল করে নির্মিত হচ্ছে নতুন বাড়ি। এদিকে নদী ভাঙন রোধে কোনো উদ্যোগ না থাকায় শত শত একর জমি নদীগর্ভে বিলীন হওয়ায় কমে যাচ্ছে ফসলি জমি।
দশমিনা উপজেলা পরিসংখ্যান অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলার চর বোরহান, চর শাহজালাল ও চর হাদিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির অস্বাভাবিক চিত্র পাওয়া গেছে। এসব চরে প্রায় ১১হাজার লোকের বসতি। প্রতি পরিবারে গড় লোকসংখ্যা ৬-৭জন। দুর্গম এসব চরের বাসিন্দারা অধিক সন্তান, অধিক উপার্জনে বিশ্বাসী।
চরের অল্পশিক্ষিত মা-বাবারা জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহার করতে নারাজ। আধা সচেতন মায়েরা উপজেলা সদরে এসে গোপনে জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি বা ইনজেকশন কিনে নেয়। তাও আবার স্বামী বা পরিবারের সদস্যদের না জানিয়ে ব্যবহার করতে হয়। শুধু তাই নয়, জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি ব্যবহার করায় অনেক সময় স্বামীর হাতে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় চরবাসী অবহেলিত নারীদের।
দশমিনার দুর্গম চর বোরহানের বাসিন্দা ফেরেজা বেগম (৩৬)। ফেরেজার স্বামীর নাম আলম ফকির। তার বিয়ে হয় মাত্র ১৩বছর বয়সে। ফেরেজা এখন ৩ কন্যা ও ১ পুত্রের জননী। তার স্বামী আরও সন্তান নিতে চান। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া লেগেই থাকে।
একই চরের বাসিন্দা বারেক গাজীর স্ত্রী শাহিনুর (৩৫) বলেন, ‘আমার ৬ সন্তান। আমার বোন হেলেনার ৫ সন্তান। চাচাতো বোন হাসিনার ৪ সন্তান। এদের প্রত্যেকের স্বামী আরও সন্তান নিতে চায়। তাদের ধারনা, বেশি সন্তান হলে লাঠিয়ালদের হাত থেকে ফসল রক্ষা করতে পারবে। পাশাপাশি আয় রোজগার বেশি হবে।’
চর শাহজালালের ৫সন্তানের জননী মোসা. হেলেনা বেগম বাসসকে বলেন, ‘পোলা মাইয়া যে দ্যায়, হে ন্যয়ুইন্না মালিক, বন্দা অয়ুইন্না ওসুদ পত্তরে খোদায় ব্যারাজী অয় ও গুনা অয় (ছেলে-মেয়ে যে দান করে সেই নেওয়ার মালিক, বাচ্চা হওয়ার বা না হওয়ার ওষুধে আল্লাহ অখুশি হয় এবং গুনাহ হয়।)’
চর হাদির বাসিন্দা মাজেদা বিবি ৬ কন্যা সন্তানের জননী। তার ছেলে নাই একটিও। তাই তিনি ছেলে না হওয়া পর্যন্ত যত সন্তান নিতে হয় তত বার সন্তান নেবেন।
দশমিনা উপজেলা পরিসংখ্যান কর্মকর্তা মো: মনিরুল হক জানান, ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী দশমিনা উপজেলার জনসংখ্যা ছিল ১ লাখ ২ হাজার ৩’শ ৮৮ জন। আর বসতবাড়ি ছিল ২৮ হাজার ৪’শ ৯০টি। ২০২২ সালের জন শুমারি ও গৃহ গণনা অনুযায়ী দশমিনা উপজেলার লোকসংখ্যা ১ লাখ ৩০ হাজার ৪’শ ২ জন। বসত বাড়ির সংখ্যা ৩২ হাজার ৯শ’ ৮১টি।
এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১১ বছরে উপজেলায় জনসংখ্যা বেড়েছে ২৮ হাজার ১৪ জন। একই সময়ে বসতবাড়ির সংখ্যা বেড়েছে ৪ হাজার ৪’শ ৯১ টি।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, গত কয়েক বছরে নদীর অব্যাহত ভাঙনে উপজেলার বীজ বর্ধন খামার, বাঁশবাড়িয়ার ঢনঢনিয়া, হাজির হাট, আউলিয়াপুর, চরঘূূর্নী, চরহাদি ও চর বোরহানসহ মোট ১ হাজার ৭শ’ ৯৪ একর জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে ।
সূত্র জানায়, দেশের সর্ববৃহৎ বীজ বর্ধন খামারের আওতায় ১হাজার ৪৪একর জমি থাকলেও এবার চাষাবাদ করা হয় সাড়ে ৪শ’ একর জমি। নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে ৬শ’ ৯৪একর জমি।
দশমিনার উপজেলার কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালের জরিপে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল ১৮হাজার ৮শ’ ১০হেক্টর। এক ফসলি জমি ১হাজার ৬হেক্টর, দু’ ফসলি ১৪হাজার ৩শ’ ৪১হেক্টর, তিন ফসলি ৩হাজার ৪শ’ হেক্টর। মোট খাদ্য উৎপাদন হয় ৫৮হাজার ৩শ’ ৩৪মেট্রিক টন।
২০১১ সালের জনসংখ্যা অনুসারে খাদ্যের চাহিদা ছিল ২০ হাজার ৮শ’ ২৯ মেট্রিক টন। উদ্ধৃত্ত থাকতো ৩৪ হাজার ২শ’ ৭৯ মেট্রিক টন। যেহেতু লোক সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে , তাই খাদ্যের চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে ।
বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কাজী আবুল কালাম বলেন, চরাঞ্চলে বেড়িবাঁধ না থাকায় ঝড় জলোচ্ছ্বাসে নদী ও সাগরের নোনা পানি ঢুকে কৃষকের ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাই চরাঞ্চলে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা একান্ত প্রয়োজন। সরকারের কাছে আমরা দ্রুত একটি স্থায়ী সমাধানের আশা করছি।
সদর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান শাহজাহান বলেন, চরহাদীতে বেড়ীবাঁধ নির্মাণের জন্য উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করেছি। বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে চরে নোনা পানি ঢুকে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. জাফর আহমেদ বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ চরাঞ্চলে নদী ও সাগরের নোনা পানি ঢুুকে কৃষকের ফসলের ক্ষতি হচ্ছে।
দশমিনা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. ইরতিজা হাসান বলেন, এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থানে জিওব্যাগের মাধ্যমে ভাঙন রোধ করা হয়েছে।
তিনি জানান, চরাঞ্চলে শীঘ্রই টেকসই বেড়িবাধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। আর নদীর ভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।