বাসস
  ০১ ডিসেম্বর ২০২১, ১৮:৪৭
আপডেট  : ০১ ডিসেম্বর ২০২১, ১৯:১৫

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষায় চাই জবাবদিহিতা এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণ

॥ মাহফুজা জেসমিন ॥
ঢাকা, ১ ডিসেম্বর, ২০২১ (বাসস): প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নাগরিক অধিকার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে দেশে যে আইন নেই, তা নয়। আইন আছে, কিন্তু নেই আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন। এজন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছেন দেশের মানবাধিকার ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ এবং প্রতিবন্ধী বান্ধব ব্যক্তি ও সংগঠনের প্রতিনিধিরা। তারা বলেছেন, প্রতিবন্ধীদের অধিকার সুরক্ষায় সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার পাশাপাশি চাই নিবিড় পর্যবেক্ষণ। 
আগামী ৩ ডিসেম্বর বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস। এই দিবসকে সামনে রেখে কথা হয় মানবাধিকার ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ এবং জীবনের চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে আসা কয়েকজন শারীরিক প্রতিবন্ধী নাগরিকের সাথে। তাঁরা মনে করেন, দেশে যথাযথ আইন থাকা সত্বেও নেতিবাচক মনোভাব, সচেতনতা ও সহমর্মিতার অভাবে প্রতিবন্ধী মানুষেরা নাগরিক অধিকার ও সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।   
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহি পরিচালক শাহীন আনাম বাসসকে বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষায় দেশে যে আইন আছে তা কার্যকর করতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিতার আওতায়
আনতে হবে। নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তিনি বলেন, শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান প্রতিটি বিষয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশগম্যতা বাড়াতে হবে। তাদের চলাচলের সুবিধা নিশ্চিত করতে তিনি প্রতিবন্ধী বান্ধব অবকাঠামো যেমন; অফিস, আদালত, রাস্তা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাজার, ধর্মশালা ও ভবন নির্মাণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আরো সংবেদনশীল হতে হবে।  
এটুআই-এর ন্যাশনাল কনসালটেন্ট (আ্যাকসিসেবিলিটি)  এবং চট্টগ্রামের ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশনের (ইপসা) প্রোগ্রাম ম্যানেজার ভাস্কর ভট্টাচার্য বলেন, আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হলে এদেশে প্রতিবন্ধীদের কোনো সমস্যাই থাকবে না। কিন্তু আমাদের দেশের নাগরিকরা এখনও প্রতিবন্ধী মানুষদের ব্যাপারে সংবেদনশীল নন। এর ফলে একজন ব্যক্তি কেবল শারীরিক প্রতিবন্ধীতার কারণে সাধারণ নাগরিক সুবিধা থেকেও  বঞ্চিত  হচ্ছেন। 
তিনি নিজে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। প্রতিবন্ধী মানুষের প্রবেশগম্যতা, তথ্য প্রযুক্তিতে অভিগম্যতা ও অন্তর্ভূ্িক্ত নিয়ে ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছেন। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ২০১৮ সালে ‘ডিজিটাল এমপাওয়ারমেন্ট অব পারসনস উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিস’ শীর্ষক ইউনেসকো পুরস্কার লাভ করেছেন।  প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবনধারা পরিবর্তনে অবদান রাখায় বিশ্বের ৩০ জন প্রভাবশালী নির্বাচিত প্রতিবন্ধী নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। বাংলাদেশ থেকে তিনিই প্রথম ‘ডি-৩০ ডিজঅ্যাবিলিটি লিস্ট-২০২১’ সম্মাননা পেয়েছেন। তা সত্বেও সম্প্রতি একটি বেসরকারি ব্যাংকে ক্রেডিট কার্ডের আবেদন করলে ব্যাংকটি তাকে ক্রেডিট কার্ড দিতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ, তিনি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। 
বাসস’র সাথে টেলিাফোন আলাপে ভাস্কর ভট্টাচার্য ব্যথিত কন্ঠে বলেন, “আমি আমার যোগ্যতা, শিক্ষা ও দক্ষতা দিয়ে দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করছি। আমি সামাজিক উন্নয়নের মূল ¯্রােতধারায় সম্পৃক্ত থেকেও কেবল দৃষ্টি প্রতিবন্ধীতার কারণে সাধারণ নাগরিক সুবিধা পাচ্ছি না। তাহলে প্রান্তিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার কিভাবে সুরক্ষিত হবে?” তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষায় সরকার তিনটি অঙ্গীকার করেছে। প্রথমত. নির্বাচনের আগে ভোট প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী ইশতেহার এ প্রতিবন্ধীদের কল্যাণের  কথা বলেছেন। দ্বিতীয়ত,“প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩” প্রণয়ন করা হয়েছে এবং তৃতীয়ত: বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদ অনুসমর্থন করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নাগরিক অধিকার সংরক্ষণে যথাযথ উদ্যোগও গ্রহণ করেছেন। তা সত্বেও আমরা সাধারণ নাগরিক অধিকার  থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। তিনি আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য সরকারী ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে আরো আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানান। 
উল্লেখ্য, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান (১৯৭২ সনের নং আইন) এর তৃতীয় ভাগের ২৮ নং অনুচ্ছেদের এক, দুই, তিন ও চার ধারায় বলা হয়েছে, “এক. কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র  বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না; দুই. রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন; তিন. কেবল ধর্ম,  গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা  কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না; এবং চার. নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের  কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না। ” 
ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)’র প্রিন্সিপাল অফিসার আয়শা সিদ্দিকা বলেন, “সংবিধানের মৌলিক অধিকার অনুচ্ছেদে নাগরিকের যেসব অধিকারের কথা বলা হয়েছে  সেখানে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণ অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির ন্যায় সমান অধিকার ভোগ করবে। এখানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন দ্বারা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার স্বীকৃত হলেও  মাঠ পর্যায়ে বা জীবন-যাপনে তার চর্চ্চা নেই।”
প্রতিবন্ধী নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির ওপর গুরুত্বারোপ করে  তিনি বলেন,  রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের প্রতিটি মানুষকে সচেতন হতে হবে। যাতে তারা একটি শিশুর জন্মদানের কাল থেকে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠা পর্যন্ত সবার প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গী ও সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট থাকে। 
তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী নারী, শিশু বা পুরুষ হুট করেই আকাশ ফুঁড়ে বের হয়ে আসে না। কোনো না  কোনো অসচেতনতা তাদের এভাবে  বৈকল্যের শিকার হতে বাধ্য করে। শরীরের নয়, বরং সমাজের সুস্থ মানুষদের মননের প্রতিবন্ধকতা দূর করবার চেষ্টা করতে হবে। প্রতিবন্ধী ব্যাক্তিদের প্রতি কি ধরনের আচরণ করা উচিত এটিও সমাজের প্রতিটি সুস্থ মানুষের জানা দরকার। 
আট মাস বয়সে পোলিও আক্রান্ত হয়ে আয়শা সিদ্দিকার একটি পা অচল হয়ে যায়। তিনি সকল প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে ¯œাতোকত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। বর্তমান কর্মস্থলে প্রায় কুড়ি বছর ধরে কাজ করছেন। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে তিনি কোনো সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেন না। সম্প্রতি তিনি পোস্ট পোলিও সিনড্রোমে আক্রান্ত হওয়ায় তার নানারকম শারিরীক সমস্যা দেখা দেয়। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক তাকে প্রতি ঘন্টায় দশ মিনিট করে শয়নে থেকে বিশ্রাম নেয়ার পরামর্শ দেন। অথচ এ বিষয়ে অফিসে বিশ্রামের সুযোগ চাইলে তাকে লিখিত আবেদন করতে বলা হয়।    
উইমেন উইথ ডিজ্যাবিলিটিস ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (ডব্লিউডিডিএফ) এর নির্বাহি পরিচালক আশরাফুন নাহার মিষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের সকল উদ্যোগ অন্তর্ভূ্িক্তমূলক করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, কেবল সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় নয়, সকল মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার কর্মপরিকল্পনা ও উন্নয়ন বাজেটে প্রতিবন্ধীদের বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।  
এড়–লিয়া তৃণমূল প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি মোছাঃ সালমা খাতুন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নাগরিক অধিকার সুরক্ষায় তাদের জন্য যথাযথ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, “প্রতিবন্ধী ভাতা মানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ভাতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে। আমি মনে করি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যার যার শারীরিক সামর্থ্য অনুযায়ী কর্মমুখী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাদের নিজ এলাকায় উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত। আর যারা চরম প্রতিবন্ধীতার শিকার তাদের জন্য ভাতার পরিমাণ বাড়াতে হবে। তবেই সমাজে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার স্থায়ী পরিবর্তন হবে।  
বগুড়া জেলার সদর উপজেলার এড়–লিয়া গ্রামের বাসিন্দা ছালমা জানান, প্রতিবন্ধী ও এতিমদের জন্য সরকারি চাকুরিতে মাত্র ১০ শতাংশ সংরক্ষিত কোটা আছে। কিন্তু বেশির ভাগ কোটাই এতিমদের দিয়ে পূর্ণ হয়ে যায়। ফলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যোগ্যতা থাকা সত্বেও কোনো সুযোগ সুবিধা পান না। তিনি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশগম্যতা বাড়াতে প্রতিটি অফিস, পাবলিক টয়লেটসহ তাদের জন্য চলাচলের উপযোগী রাস্তাঘাট বানানোর প্রতি আন্তরিক হতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।
সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আশরাফুল আলী খান খসরু বাসসকে এক টেলিফোন আলাপে বলেন, রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সমান অধিকার। তাই তারা যাতে সমভাবে সব অধিকার ভোগ করতে পারেন তার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। প্রতিটি মেট্রোপলিটন সিটিতে রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ ও ভবনসমূহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চলাচল উপযোগী করে নির্মাণ করা হচ্ছে। সরকারি চাকুরিতে প্রতিবন্ধী কোটা বাড়ানো হবে কিনা প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমানে যে কোটা সংরক্ষিত আছে তাই পূর্ণ হচ্ছে না। তবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাহিদা বৃদ্ধি পেলে কোটা বাড়ানোর চিন্তাভাবনা করা হবে। 
 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়