বাসস
  ০৪ অক্টোবর ২০২১, ০৯:৪২

নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে গ্রামাঞ্চলে এখন অসচেতনতা অনেকটাই কমেছে

ঢাকা, ৪ অক্টোবর, ২০২১ (বাসস) : ডিজিটাল বাংলাদেশে শহর ও গ্রামের দূরত্ব অনেক কমে গেছে। ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, স্বাস্থ্যকর্মী কিংবা কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখতে পারছেন নারীরা। আর বাড়ির পাশের হাসপাতাল কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রসব পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সেবা এবং ওষুধ বিনামূল্যে নিতে পারছেন গর্ভবর্তী নারীরা।
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত বেশে এগিয়েছে। এক্ষেত্রে মানুষের চিকিৎসা নেয়ার হার যেমন বেড়েছে তেমনই বৃদ্ধি পেয়েছে তৃণমূলে মানুষের সচেতনতাও। এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই গ্রামের নারীরাও, সমান তালেই তারাও এগিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সংজ্ঞা অনুযায়ী, প্রজনন স্বাস্থ্য বলতে সামগ্রিকভাবে শারীরিক, সামাজিক ও মানসিক কল্যাণের সমন্বয়ে সন্তান জন্মদানের পরিপূর্ণ প্রক্রিয়াকে বোঝায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ১৫-২৪ বছর বয়সী জনগোষ্ঠী হচ্ছে প্রজননক্ষম অংশ। তবে প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাবে এসব নারীই বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকেন।
বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের মাত্র ১৩ শতাংশ নারী প্রসবকালে দক্ষ ধাত্রীর সেবা পান। বাকিরা ঝুঁকিপূর্ণভাবেই সন্তান জন্ম দেন। এক্ষেত্রে অনেক সময় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রাণ হারান অনেক প্রসূতি।
তবে আশার কথা হচ্ছে প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে আগে গ্রামাঞ্চলে যে অসচেতনতা ছিল, তা দিনে দিনে অনেকটা কমেছে। সচেতন হয়ে উঠছেন নারীরা।
রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের গাইনী রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শামসাদ জাহান বলেন, দেশের ৫০ শতাংশ নারী প্রজননতন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যায় ভোগেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গর্ভপাত, জরায়ুর মুখে আঘাত, জরায়ু ও প্রজননপথের মুখ ফেটে যাওয়া প্রভৃতি।
তিনি আরো বলেন,‘তবে বর্তমানে নারীরা এ বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের গর্ভবতী নারীরাও এখন প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে অনেক বেশি সচেতন। ফলে আগের তুলনায় প্রজনন সংক্রান্ত সমস্যা কমছে।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের জাতীয়ভাবে প্রজনন হার ছিল ২ দশমিক ১১ শতাংশ, যা ২০১২-তে ছিল ২ দশমিক ১২ শতাংশ, ২০১১ সালে ছিল ২দশমিক ১১ শতাংশ এবং ২০০৯ সালে ছিল ২ দশমিক ১৫ শতাংশ।
বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে প্রতি হাজারে প্রজনন হার ৬৭ শতাংশ। আর গ্রামীণ এলাকায় এ হার ৭৭ শতাংশ। শহরের নারীরা প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে বেশি সচেতন হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এতদিন তা ছিল গর্ভকালীন সচেতনতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
তবে এখন শহরের নারীরা জরায়ু ক্যান্সার, ফিস্টুলাসহ জরায়ু ও প্রজননতন্ত্রের বিভিন্ন অসুখের ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন। সচেতনতার হার অনেক বেশি ছড়িয়ে গেছে গ্রামীণ নারীদের মধ্যেও।
নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা একটি বেসরকারি সংস্থার প্রধান ডা. নাজনীন আখতার বলেন, আগে লোকলজ্জার ভয়ে গ্রামীণ নারীরা বিভিন্ন অসুখের কথা কাউকে বলতে চাইতেন না। তবে এখন সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। এখন তারা গর্ভকালীন পরিচর্যা শুরু করে প্রজননতন্ত্রের নানা অসুখ লুকিয়ে না রেখে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষা করাচ্ছেন, চিকিৎসা নিচ্ছেন।
বর্তমানে নারী প্রতি গড় সন্তান সংখ্যা ২ দশমিক ২ শতাংশ বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
এদিকে বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনার হারও বেড়েছে। নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যে সচেতন করে তুলতে ও সেবা দিতে সরকারের পাশাপাশি কাজ করছে বিভিন্ন এনজিও ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র।
২০১৪ সালে বিডিএইচএস-এর জরিপ অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬২ শতাংশ। ১৯৯৬ সালে এ হার ছিল ৪৯ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, নার্সিং সেবা পরিদপ্তর ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বিভিন্ন শহরে নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছে। বর্তমানে ৭৭ শতাংশ নারী প্রসবোত্তর সেবা নিচ্ছেন।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সূত্রমতে, বর্তমানে পরিবার পরিকল্পনায় ৭০ শতাংশ চাহিদার বিপরীতে ৪২ শতাংশ কিশোরী ও ৫২ শতাংশ তরুণী বর্তমানে কোনো না কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করছেন।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাহান আরা বানু মনে করেন, মূলত নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি, প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, প্রচার, পরামর্শ, স্বল্পমূল্য ও বিনামূল্যে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করার কারণেই নারীরা এখন প্রজনন স্বাস্থ্যে অনেক বেশি সচেতন হয়ে উঠেছেন। এটা একটা জাতির জন্য খুবই ভালো দিক।
সূত্র জানায়, দেশে ১৩ হাজার ৮১২টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এসব ক্লিনিকের ১ হাজার ৯৩৫ জন নারী সিএইচসিপি (ক্লিনিককর্মী) সিএসবিএ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ফলে কমিউনিটি ক্লিনিকেই প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তর সেবা পাচ্ছেন গ্রামীণ নারীরা।
এদিকে বছর তিনেক আগে হাওরাঞ্চলে সিএইচডব্লিউ কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কার প্রকল্পের মাধ্যমে ৩০০ জন ধাত্রী নিরাপদ প্রসবে গ্রামীণ নারীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
এ প্রকল্পের ফলে হাওর এলাকার প্রসূতি মায়েদের স্বাস্থ্যসেবা, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য সহজলভ্য হয়েছে বলে মনে করেন সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খায়রুল হুদা চপল।
ধর্মপাশায় কার্যক্রম চালানো একটি এনজিও’র কর্মী শাহীন আহমেদ বলেন, বর্তমানে হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে গর্ভবতী নারীদের বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, স্যাটেলাইট ক্লিনিক, কমিউনিটি ক্লিনিকে এসব সেবা দেয়া হচ্ছে।
কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ারের (সিবিএইচসি) লাইন ডিরেক্টর ডা. সহদেব চন্দ্র রাজবংশীর মতে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো দেশের মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু হার হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আর বর্তমানে দেশের গ্রামীণ নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ ও সচেতনতা উন্নয়নশীল বিশ্বে এখন রোল মডেল হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।
 

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়