বাসস
  ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:১৬

ভাওয়ালে সড়ক রক্ষাণাবেক্ষণের মাধ্যমে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন

ঢাকা, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ (বাসস) : ‘চল বো ভাইজান মাটি কাটা, চাইয়া রইলি কার পানে, ... রাস্তার ধারে কাটবো মাটি/অর্ডার দিছে চেয়ারম্যানে...’ গ্রামীণ সড়কের রক্ষাণাবেক্ষণে নারী শ্রমিকদের রাস্তায় মাটি ফেলাসহ রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি এভাবেই গানে গানে তুলে এনেছিলেন বাউল স¤্রাট আবদুল করিম।
সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণ করে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে মজুরি পেতেন নারী শ্রমিকরা। এখনও আবহমান গ্রাম-বাংলার বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়কে কোদাল-ঝুড়ি নিয়ে মাটি কাটতে দেখা যায় নারী শ্রমিকদের। এক্ষেত্রে আজও বাউল স¤্রাটের সেই গান বেশ মানানসই।
এমন দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে গাজীপুরের ভাওয়াল গড়ে। নিত্যদিন সেখানকার বিভিন্ন সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজটি করে চলেছেন নারীরা। ২০২০ সালের মার্চে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে নিম্ন আয়ের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে কর্মহীন হতে হয়েছে। কিন্তু এলজিইডির একটি প্রকল্পের নারী শ্রমিকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনার এই দুঃসময়েও কাজ চালিয়ে গেছেন এবং নিয়মিত মজুরি পাচ্ছেন।
সম্প্রতি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় সরেজমিনে দেখা যায়, ভাওয়ালের গভীর অরণ্যের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া আঁকাবাঁকা পিচঢালা সড়কে দা, কোদাল, কাস্তে হাতে রাস্তা পরিষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে চলেছেন একদল নারী।
রাস্তার উপর জন্মানো ঘাস, পড়ে থাকা কাদা-মাটি, সড়কের পাশে জন্ম নেয়া ঝোপ-ঝাড় পরিষ্কার করে চলাচলে ঝুঁকি কমানো, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও সড়কের স্থায়িত্ব বাড়াতে কাজ করছেন তারা। পাশাপাশি সড়কের সৌন্দর্যও বেড়েছে।
জানা যায়, গ্রামীণ এ সড়কটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের আওতাভুক্ত। ওই সড়কে এলজিইডির তত্ত্ববধানে প্রতিটি ইউনিয়নে ১০ জনের একটি দল সপ্তাহে ছয়দিন রাস্তা পরিচর্চার কাজ করেন। শ্রীপুর উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে ৮০জন সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ নারীকর্মী রয়েছেন।
প্রতিদিন সকাল ৮টায় শুরু করে দুপুর ২টা পর্যন্ত চলে তাদের কাজ-কর্ম। এর মাঝে খাওয়া, আড্ডা গল্প এমনকি প্রয়োজনীয় আলোচনাও রাস্তার পাশে বসে সেরে নেন তারা।
এলজিইডি সূত্রে জানা যায়, ‘পল্লী কর্মসংস্থান ও সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচি-৩ (আরইআরএমপি-৩)’ এর আওতায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। আর এই প্রকল্পে যেসব নারী সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করছেন তারা প্রায় সবাই দুস্থ, অনেকে স্বামী পরিত্যক্তা।
তাদের এই কাজে নিয়োগ দেয়ার ফলে একদিকে যেমন বেকারত্বের অবসান হচ্ছে, অন্যদিকে সড়কের স্থায়িত্বও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার সুফল ভোগ করছে স্থানীয় জনগণ।
আর হাড়-খাটুনী পরিশ্রম করে এসব নারী আয়-রোজগার করছেন। সংসারে সিদ্ধান্তগ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। এতে গ্রামীণ নারীরা যেমন নিজে স্বাবলম্বী হচ্ছেন, তেমনই তাদের ক্ষমতায়নও হচ্ছে যা বর্তমান সরকারের অন্যতম লক্ষ্য।  
এ বিষয়ে নারী নেত্রী জিনাত হক বলেন, এই কাজের ফলে গ্রামীণ নারীদের অসহায়ত্ব দূর হয়েছে। দেখা যাচ্ছে- যারা সড়কে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন তাদের কারও স্বামী নেই, কেউ বা সহায়-সম্বলহীন। এক্ষেত্রে এই কাজ তাদের  বেঁচে থাকতে সহযোগিতা করছে।
ভাওয়ালের সড়কটিতে আগাছা পরিষ্কারে ব্যস্ত হোসনে আরা। তিনি শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নে রাস্তার উন্নয়নে কাজ করা নারীশ্রমিক সংগঠনের সভাপতি। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে হোসনে আরা বলেন, আমরা সাধারণত রাস্তার ছোটখাট মেরামত ও সংরক্ষণের কাজ করি। যেমন- কার্পেটিংয়ের উপর ঘাস তোলা, সড়কের পাশে গর্তে পানি জমে থাকলে নিষ্কাশনের জন্য ড্রেন করে দেয়া, গর্ত ভরাট করা, সড়কের শোল্ডারে মাটি সরে গেলে সেখানে মাটি দিয়ে মেরামত করা এবং ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে দেয়া ইত্যাদি।
মোছা. তাসলিমা বেগম, বয়স চল্লিশ। তিন বছর ধরে রাস্তার শ্রমিকের কাজ করছেন উপজেলার কাওরাইদ গ্রামের এই বাসিন্দা। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, উপজেলার এলজিইডির কর্মকর্তাদের নির্দেশনা মোতাবেক মাসের একেক দিন একেক সড়কে কাজ করি।
তাসলিমা জানান, শোল্ডার/স্লোপ ক্ষতিগ্রস্ত বেশি এমন সড়কে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করেন তারা। এতে যা আয় তা দিয়ে ভালোভাবে চলে যায় তার। স্বামী মোমেন মিয়াও আয় করেন রিকশা চালিয়ে। দুইজনের আয়ের কারণে এখন সংসারে টানাপোড়েন নেই।
শ্রমিকের কাজ করে সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন স্থানীয় প্রহ্লাদপুর ইউনিয়নের স্বামী পরিত্যক্তা ভজনা রানী দাস।
তার ভাষ্য, মাসিক সাড়ে সাত হাজার টাকা বেতনে এই কাজ করি। এর মাঝে ২হাজার ৪০০ টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সঞ্চয় হিসাবে বাধ্যতামূলক জমা করতে হয়। বাকি টাকা দিয়ে এক সন্তান ও মাকে নিয়ে ভালোভাবে জীবনযাপন করছি। আমার একমাত্র সন্তানকে লেখাপড়া করাতে পারছি। এখন কোনো অভাব নাই।
ভজনা রানী জানান, প্রকল্পের অধীনে অল্প টাকায় ঘরের কাজের পাশাপাশি কিছু করার জন্য এলজিইডি মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। মাসিক মজুরি থেকে যে ২হাজার ৪০০ টাকা জমা হচ্ছে। তা প্রকল্পের মেয়াদ শেষে একবারে উত্তোলন করা যাবে।
‘ওই টাকা একত্রে পেলে এসব প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে নিজের স্বাভাবিক জীবন-যাপনের জন্য স্থায়ীভাবে আয়ের একটা ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে। তখন কারও কাছে হাত পাততে হবে না।’
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপজেলা প্রকৌশলী এ জেড এম রকিবুল আহসান জানান, সাধারণত বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা এবং নারী পরিবার প্রধান হতদরিদ্র ও দুস্থ মহিলা; যারা কায়িক শ্রমের মাধ্যমে জীবিকা অর্জনে সক্ষম তারা এ কর্মসূচির মাধ্যমে কাজ করেন। তাদের দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে ২৫০ টাকা মজুরি দেয়া হয়। ‘এছাড়া তাদের স্বাবলম্বী করতে হাস-মুরগী ও গরু-ছাগল পালন, মাছ চাষ, ঘরের আঙিনায় সবজি চাষ প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। যোগ করেন।
প্রকল্পটির দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এনায়েত উল্লাহ।
তিনি বলেন, মরণঘাতী করোনার কারণে দেশজুড়ে নিম্নআয়ের মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে নারী শ্রমিকরা সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ ও সৌন্দর্যবর্ধনে কাজ করে চলেছেন। এক্ষেত্রে তাদের এই সঙ্কটে  তেমন পড়তে হচ্ছে না।
এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুর রশীদ খান বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে এলজিইডি বিশাল কর্মযজ্ঞ নিয়ে শহরেও সমানভাবে কাজ করছে। গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে কারিগরি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নে যাতে এলজিইডিও ভূমিকা রাখতে পারে সেজন্য যুগোপযোগী নানা ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, পল্লী কর্মসংস্থান ও সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচি-৩ (আরইআরএমপি-৩)’ তেমনই একটি প্রকল্প। এর আওতায় সারাদেশের ৬৪ টি জেলার প্রতিটি ইউনিয়নে ১০ জন করে নারী কর্মী ৪ বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যারা সারা দেশে এলজিইডির আওতাধীন সড়কসমূহ বছরব্যাপী রক্ষণাবেক্ষণ করে চলেছেন।

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়