বাসস
  ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৫:৪০

আগামীকাল ১০ডিসেম্বর নড়াইল মুক্ত দিবস

// শরিফুল ইসলাম //
নড়াইল, ৯ ডিসেম্বর, ২০২৩ (বাসস): আগামীকাল ১০ডিসেম্বর নড়াইল মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিপাগল দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্তদিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত করে তাদের হাত থেকে নড়াইলকে মুক্ত করে। 
এ উপলক্ষে নড়াইল জেলা প্রশাসন, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ইউনিট, চিত্রা থিয়েটারসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
 কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- রোববার সকালে বধ্যভূমি, গণকবর, স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পন, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ও  বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে পুষ্পমাল্য অর্পন, র‌্যালি ও আলোচনাসভা। এছাড়া বিকেলে নড়াইল মুক্ত দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হবে চিত্রা থিয়েটারের আয়োজনে নাটক অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশফাকুল হক চৌধুরী।
মুক্তিযোদ্ধা জেলা ইউনিট কমান্ডের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা এড. এসএ মতিন বাসসকে জানান- ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে স্বাধীনতার যে আহ্বান ছিল নড়াইলের মুক্তিপাগল জনতা তা থেকে পিছপা হয়নি। ওই সময় নড়াইলের এসডিও’র বাসভবনকে স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধের হাই কমান্ডের সদর দপ্তর করা হয়। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে তৎকালীন নড়াইলের এসডিও কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, এমএনএ খন্দকার আব্দুল হাফিজ, এমপিএ শহীদ আলী খান, আওয়ামী লীগ নেতা এখলাছ উদ্দিন, বিএম মতিয়ার রহমান লোহাগড়া হাই স্কুলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও নড়াইলের সংগঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের এক করে বিশাল বাহিনী যশোর অভিমুখে পাঠিয়ে দেন।
৬ এপ্রিল সকালে পাক হানাদার বাহিনী দুটি জেট বিমান হতে নড়াইল শহরের ওপর ব্যাপকভাবে মেশিনগানের গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে প্রচুর ক্ষতি সাধন করলে নড়াইল শহর জনশুন্য হয়ে পড়ে। ১৩ এপ্রিল হানাদার বাহিনীর একটি দল নড়াইল শহরের চৌরাস্তায় রেস্টুরেন্ট মালিক মন্টুকে গুলি করে আহত করে এবং হরিপদ সরদার, ভাটিয়া গ্রামের কালু বোস, সরসপুর গ্রামের প্রফুল্য মিত্রকে ধরে নিয়ে দাইতলা পুলের নিকট গুলি করে ফেলে রেখে চলে যায়।
এদিকে ক্যাপ্টেন দোহার উদ্যোগে লোহাগড়ার ইতনা ও আড়িযারায় প্রশিক্ষণ শিবির খোলার কারনে মধুমতি-নবগঙ্গা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের ভাটিয়াপাড়াস্থ হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প হতে তাদের দোসর দের সহযোগিতায় গানবোট যোগে ইতনা গ্রামে নৃশংস অভিযান চালিয়ে ওই গ্রামের ৫৮ জন নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করে।
ওই সময় নড়াইলের জামায়াত নেতা মওলানা সোলায়মানের নেতৃত্বে “শান্তিবাহিনী গঠিত হয়”। এ বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে দেশপ্রেমিক শত-শত মানুষকে ধরে এনে নড়াইল ডাকবাংলোয় আটক রাখা হত। এসব ব্যক্তিদের জল্ল¬াদরা গভীর রাতে নড়াইল শহরের লঞ্চঘাটের পল্টুনের ওপর নিয়ে জবাই করে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিত। 
দেশ হানাদার মুক্ত করার এক দূর্জয় আকাংখা নিয়ে মুক্তি বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে সদর থানায় উজির আলী, লোহাগড়া থানায় মোক্তার আলী, ও কালিয়া থানায় ওমর আলীকে এবং মুজিব বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে সদর থানায় শরীফ হুমায়ুন কবীর, লোহাগড়া থানায় শরীফ খসরুজ্জামান ও কালিয়া থানায় আব্দুল মজিদ সরদারকে নিযুক্ত করলে তারা নড়াইলে প্রবেশ করে। অক্টোবর মাস হতে জেলার প্রত্যান্ত অঞ্চলের মুক্তিপাগল মানুষের মনে এক বিশ্বাস জন্মাতে থাকে যে হানাদার বাহিনী বা তাদের দোসররা আর বেশীদিন টিকতে পারবেনা। 
ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকেই নবগঙ্গা নদীর উত্তর ও পূর্বাঞ্চাল হানাদার মুক্ত হয়ে যায়। লোহাগড়া থানা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঘাঁটিকে ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তি বাহিনীর কমান্ডারগণ আতœসমর্পনের নির্দেশ দিলে তারা আতœসমর্পন না করায় ৮ ডিসেম্বর শরীফ খসরুজ্জামান, দবির উদ্দিন, ইউনুস আহমেদ, লুৎফর মাস্টার, আলী মিয়া, লুৎফর বিশ্বাসসহ অনেক গ্রুপ একত্রিত হয়ে সম্মিলিতভাবে তিন দিক থেকে লোহাগড়া থানা আক্রমণ করলে প্রচন্ড যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী আতœসমর্পন করে। 
এরপর মুক্তিযোদ্ধারা নড়াইলে হানাদার বাহিনীর ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ৮ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী এস এম ফজলুর রহমান জিন্নাহ’র নেতৃত্বে নড়াইল কলেজের দক্ষিণে মাছিমদিয়া গ্রামে সমবেত হয়ে পুলিশ-রাজাকারদের উপর অতর্কিত হামলা চালালে এই যুদ্ধে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা জয়পুরের মিজানুর রহমান হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন। মিজানুর রহমানের মৃতদেহ হানাদার বাহিনীর দোসররা হাত-পা বেঁধে বাঁশে ঝুলিয়ে নড়াইল শহর প্রদক্ষিণ করে কৃতিত্ব দেখায় এবং ছবি তোলে।
এ ঘটনার পর ৯ ডিসেম্বর রাতে বিজয়ের তীব্র আকাংখা নিয়ে কমান্ডার ফজলুর রহমান জিন্নাহ, আমির হোসেন, উজির আলী, শরীফ হুমায়ুন কবীর, আ. হাই বিশ্বাসের নেতৃত্বে বর্তমান নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ চালালে পাল্টা আক্রমণে বাগডাঙ্গা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমান শহীদ হন। শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাংলোতে অবস্থানরত ৪০ জন পাকিস্তানি মিলিটারিকে আতœসমর্পনের নির্দেশ দিলে তারা আতœসমর্পনে অস্বীকার করেন। 
এসময় মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা চতুদিক থেকে প্রচন্ড গোলাবর্ষণ শুরু করলে পাক মিলিটারিরা আতœসমর্পন করতে বাধ্য হয়। এখানে কয়েকজন পাকিস্তানি মিলিটারি নিহত হয় এবং অন্যদের জেল হাজতে পাঠানো হয়। 
শীতের রাতে প্রবল শীতকে উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধারা সারারাত শহরে বিজয় উল¬াস করতে থাকে ও জয় বাংলা শে¬াগানে শহর প্রকম্পিত করে তোলে এবং ১০ ডিসেম্বর  বেলা ১১ টার দিকে নড়াইলকে পাক হানাদার মুক্ত ঘোষণা করা হয়। পরে মুক্তিপাগল হাজারো জনতার উপস্থিতিতে ডাকবাংলো প্রাঙ্গনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়