বাসস
  ২৪ জুলাই ২০২৫, ১৭:২৫

খায়রুল হকের বিচার চাইলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা

ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা, ২৪ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের বিচার চেয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা।

এবিএম খাইরুল হক ডিবির হাতে আটকের খবর প্রকাশিত হবার পর সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবীরা আজ তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, এই খায়রুল হকের কারণে বিগত একটি নির্বাচনও সুষ্ঠু হয় নাই। শুধু তাই নয়, এই খায়রুল হকের কারণে আয়নাঘর হয়েছে। এই খায়রুল হকের কারণে হাজার মায়ের কোল খালি হয়েছে। এই খায়রুল হকের কারণে লক্ষ লক্ষ অবৈধ মামলা হয়েছে। তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কটাক্ষ করেছেন। এই খায়রুল হক খালেদা জিয়াকে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। এর জন্য খায়রুল হক দায়ী। এই দায় খায়রুল হক এড়াতে পারেন না। তাই সরকার প্রধানকে বলব, অনতিবিলম্বে এবং সব কিছুর আগে খায়রুল হকের বিচার এমনভাবে করবেন, যাতে জনতা বুঝতে পারে এই দেশে অবিচার করলে, বিচার বিভাগকে ধ্বংস করলে কী হয়! ভবিষ্যতেও বিচারপতিরা সাবধান হয়ে যাবেন। আমি আশা রাখি এই সরকার দৃষ্টান্তমূলক বিচার করবেন। যাতে মানুষ মনে করে এই আদালতে বিচার হচ্ছে, সেটা জনগণের আদালত। তাহলে আমরা খুশি হবো। খায়রুল হককে এমনভাবে বিচার করতে হবে জনতা যাতে সেই বিচার দেখতে পায়।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, তিনি সেই সাবেক প্রধান বিচারপতি যার কারণে দেশের মানুষ বছরের পর বছর তদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। তার বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত, রায়, পদক্ষেপ বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রমাণিত। খায়রুল হক তত্ত্বাবদায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংঘাতের সৃষ্টি করেছিল। জাতিকে একটি কঠিন রাজনৈতিক সঙ্কটে ফেলেছিল। মৌলিক অধিকার বিনষ্ট করেছিল।

ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে খায়রুল হকের রায় বিচার বিভাগের সঙ্গে প্রতারণা, সংবিধানের সঙ্গে প্রতারণা। বিচারপতিরা পক্ষপাতদুষ্ট হলে কি হয়, আজ তার গ্রেপ্তার হওয়া এটাই প্রমাণ করে। বিচারপতিরা যদি অবিচার করেন, পক্ষপাতমূলক বিচার করেন, ভবিষ্যতে তাদের কিন্তু খায়রুল হকের মত বিচার হওয়ার সম্ভাবনা আছে। শুধু উচ্চ আদালত নয় নিম্ন আদালতের বিচারকরদেরও। খায়রুল হক ন্যায়পরায়ণ, পক্ষপাতহীন ছিলেন না। তিনি ছিলেন ব্যক্তিত্বহীন, রাজনৈতিক অনুগত। তার রায় ছিল জনগণের বিরুদ্ধে। তিনি কতটা নির্লজ্জ ছিলেন। তার প্রমাণ হচ্ছে বিচার বিভাগের প্রধান থেকে অবসরে যাওয়ার পর আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। তিনি বিচার বিভাগের মর্যাদার কথা চিন্তা করেননি। তার উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা। গত ১৫-১৬ বছরে বাংলাদেশে যে হত্যা, গুম, গ্রেফতার হয়েছে, এর জন্য সাবেক বিচারপতি খায়রুল হকই দায়ী। জনগণ এবং আইনজীবীরা তার যেন সুষ্ঠু বিচার হয়, তার যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় সেই দাবি জানাচ্ছি।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম বলেন, যেদিন থেকে বিচারপতি খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি হন, সেদিন থেকে বিচার বিভাগ নষ্ট হওয়া শুরু হয়। তিনি বিচারের নামে অবিচার করে গেছেন। দলের প্রতি তার যে আনুগত্য ছিল। এই আনুগত্য তিনি চরিতার্থ করেছেন তার আচরণে, শারীরিক ভাষায়, তার রায়ে পরিষ্কারভাবে প্রকাশিত হয়েছে। যেটি একজন বিচারপতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধতা হওয়া উচিত। ত্রয়োদশ সংশোধনী নিয়ে যে রায় হয়েছে, তাতে করে তিনি গণতন্ত্রকে হত্যা করেছেন। মৌলিক কাঠামোর নাম করে যে বিষয়টিকে তিনি বাতিল করে দিয়েছিলেন সেটি মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। শুধুমাত্র একটি বিশেষ দলকে সুবিধা দেওয়ার জন্য তিনি ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ে আইনের অপপ্রয়োগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছিলেন। তার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ বহু বছর একটি সুষ্ঠু নির্বাচন পায়নি। এর প্রধান কারিগর ছিলেন খায়রুল হক। তার সবচেয়ে বড় অন্যায় ছিল, তিনি একটি বিশেষ দলের সমর্থক। বিশেষ দলের যারা কর্মী, তাদের প্রতি তার আনুগত্য বিচারকাজে বার বার সেটি প্রকাশিত হয়েছে। বিচারকের যে বিচক্ষণতা, নিরপেক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি, গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হয় সেটি তার ছিল না। এটাই অবধারিত যে আজ হোক, কাল হোক তার বিচার হবে। সে কারণে আজ তাকে বিচারের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

খায়রুল হককে জ্ঞানপাপী উল্লেখ করে বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, এদেশের গণতন্ত্র হত্যা এবং শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট এবং এক নায়ক করার প্রধান প্রকৌশলী হচ্ছেন খায়রুল হক। শেখ হাসিনা যেমন তার নির্দেশে শত-সহস্র মানুষকে হত্যা করেছে, খায়রুল হক সেজন্য সমভাবে দায়ী। আমরা দীর্ঘদিন আইনজীবী সমাজ খায়রুল হককে গ্রেপ্তারের জন্য আন্দোলন করেছি, খায়রুল আজ গ্রেপ্তার হয়েছেন। আইনজীবী সমাজ এতে আশান্বিত। তখনই সন্তুষ্ট হব, যখন খায়রুল হকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বলতে আমরা বুঝাচ্ছি, এমন শাস্তি হওয়া উচিত যেন ভবিষ্যতে প্রধান বিচারপতি বা সুপ্রিম কোর্টের অন্য বিচারকের আসনে বসে নতুন খায়রুল হক সৃষ্টি না হয়। গণতন্ত্র হত্যার মত খায়রুল হক যে অন্যায় করেছন, শত-সহস্র মানুষকে কোরবান হতে হয়েছে, এমন কোনো জ্ঞানপাপী যেন বিচারকের আসনে নতুন খায়রুল হক জন্ম না নেয়। সেটিই প্রত্যাশা। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিটা যখন নিশ্চিত হবে তখন আমরা সন্তুষ্ট থাকবো।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, বাংলাদেশের বিচারপতিরা যে শপথ নেন, সেখানে বলা আছে কোনো রকম রাগ, অনুরাগ বিরাগের বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন না। আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। কিন্তু এই বিচারপতি খায়রুল হক অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে। এটা আসলে কী? অভিযোগটা কি? অভিযোগটা হলো- একটা আদেশ যা উন্মুক্ত আদালতে ঘোষণা করা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ রায় দেওয়ার সময় এই আদেশটাকে পরিবর্তন করে ফেলেছেন। এই যে পরিবর্তন করে ফেলা, এই পরিবর্তন করে ফেলার মাধ্যমে যে বিচারিক প্রতরাণা করা হয়েছে, এই প্রতরাণা আমরা আর কোনোভাবেই বিচার বিভাগ থেকে দেখতে চাই না। যেই করুক না কেন, যত বড় বিচারকই করুক না কেন, ইটস এন অফেন্স (এটি অপরাধ)। বিচারিক আদালতের ঘোষিত রায় পরবর্তীতে আরেকটি বিচার ছাড়া এইভাবে পরিবর্তন করে ফেলা যায় না। আমি মনে করি এটি মার্জনা অযোগ্য, এমনটা হতে পারে না। বাংলাদেশে সব চাইতে বিপজ্জনক যা ঘটেছে, সেটি বলেছিলেন বিচারপতি টি এইচ খান। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মামলায় অ্যামিকাস কিউরি ছিলেন। তিনি এসে আদালতে বলেছেন, আপনারা আজকে যে আগুন নিয়ে খেলছেন, দেশ কিন্তু এই আগুনে পুড়বে। যদি এই সিস্টেম (ব্যবস্থা) আপনারা বাতিল করেন। আপনারা দেখবেন, বিগত ১৫ বছরে আমাদের এই মাতৃভূমিতে আগুনই জ্বলেছে। নির্বাচন কমিশন ধ্বংস হয়ে গেছে, নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে আমি মনে করি বিচারপতি খায়রুল হক যদি এই প্রতারণা না করতেন তাহলে পরবর্তীতে এই ধরনের পরিস্থিতি বা বাস্তবতা জাতিকে বহন করতে হতো না। এই জন্য বিচার হবে আইন অনুযায়ী। বিচার আইনের বাইরে করা যাবে না। যে আইনে তিনি দোষী সাব্যস্ত হবেন সেই আইন অনুযায়ীই তার বিচার করতে হবে। বিচারের ক্ষেত্রে যাতে অবিচার করা না হয়, সেটাও আমরা সতর্কতার সঙ্গে বলতে চাই। কোনো ব্যক্তিকেই যেন তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা না হয়।

সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে বৃহস্পতিবার সকালে তার ধানমন্ডি বাসা থেকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। খায়রুল হক বাংলাদেশের ঊনবিংশতম প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১০ সালের পহেলা অক্টোবর থেকে ২০১১ সালের ১৭ মে পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন। পরে ২০১৩ সালের জুলাইয়ে তাকে তিন বছরের জন্য আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। গত ১৩ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর আইন কমিশন থেকে পদত্যাগ করেন খায়রুল হক। এদিকে গত ৫ আগস্টের পর খাইরুল হকের বিরুদ্ধ দুটি মামলা হয়। রায় জালিয়াতি ও দুর্নীতির অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন একটি মামলা করেন শাহবাগ থানায়। আর সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পরিবর্তন ও জালিয়াতির অভিযোগে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায় করা হয় আরেকটি মামলা।