শিরোনাম
তানভীর হায়াত খান
নেত্রকোণা, ৫ আগস্ট ২০২৫ (বাসস) : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন দেশের জেলায় জেলায় এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। থেমে থাকেনি নেত্রকোণার ছাত্র সমাজও । তবে আওয়ামী বাহিনীর হুমকী ও প্রতিরোধের মুখে প্রতিটি মিছিল ও সমাবেশের চেষ্টা বিফল হচ্ছিল। তবুও আশা ছাড়েন নি নেত্রকোণার তরুণরা।
শহরে থমথমে অবস্থা। শহরের ছাত্রনেতা, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের ফোন করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হুমকি। তারমধ্যেই বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে জেলার আন্দোলন চাঙ্গা করার জন্য পথে নামেন রুদ্র ও তার বোন সাবা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মোবাইল ফোন ও ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে জেলার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যান। আর তাদের বিভিন্নভাবে সমর্থন জানান, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক, কবি, লেখক ও চিন্তকরা। প্রতিরোধ ও হুমকি উপেক্ষা করে রুদ্রর এই চেষ্টা চব্বিশের আন্দোলনে তারুণ্যের অগ্রযাত্রারই প্রতিফলন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ৪ আগস্ট, রোববার সকাল থেকে শহরের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ ‘রাস্তায় আর নামিস না, পিঠের চামড়া থাকবেনা’ স্লোগানসহ দেশীয় অস্ত্রসহ মহড়া দেয়। জেলার পূর্বধলা উপজেলার নেত্রকোনা-ময়মনসিংহ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা। শ্যামগঞ্জ বাজারে আন্দোলনকারীরা পুলিশের গাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। এসময় পুলিশের অস্ত্র লুটপাটের অভিযোগ ওঠে। ৬ পুলিশ সদস্য আহত হয় এবং সাতটি পিস্তল লুট করে নিয়ে যায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
এদিন সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সাথে কুড়পাড়, পারলা বাসস্ট্যান্ড, নাগড়া সাতপাই কলেজ রোড এলাকায় ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হয়।
সময় টিভি ও বাংলাদেশ প্রতিদিন এর জেলা প্রতিনিধি আলপনা বেগম বাসসকে জানান, জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ফোনে ক্রমাগত প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছিল। তারা ৪ আগস্ট তাদের দলীয় কার্যালয়ে আলপনা বেগমকে দেখা করতে বললেও তিনি সেখানে যান নি।
যমুনা টিভির জেলা প্রতিনিধি কামাল হোসেন জুলাই আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করে বাসসকে বলেন, ৪ আগস্ট সকাল দশটার দিকে একরামুল হক সানিম নামে একজন শিক্ষার্থী তাকে ফোন করে জানান, তারা নেত্রকোণা সরকারি কলেজের মাঠের কোণায় ১০ টার দিকে একত্রিত হয়ে আন্দোলন করবেন এবং এ তথ্য যেন আর কাউকে না জানানো হয়। যথারীতি তারা সেখানে জমায়েত হতে থাকেন। কিন্তু তাদের এ জমায়েত হওয়ার খবর আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা জেনে যায় এবং সেখানে অতর্কিত আক্রমণ করে।
ফলে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এসময় সাইকেলে করে দাঁড়ি, টুপি, পাঞ্জাবি পরিহিত এক যুবক যাচ্ছিলেন সরকারি কলেজের সামনে দিয়ে। তার সাথে এক নারী ছিলেন। ঐ যুবককে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা পথ আটকে দাঁড় করিয়ে তার ব্যাগ চেক করে বাংলাদেশের একটি জাতীয় পতাকা ও একটি চাকু পায়। তারা ঐ যুবককে কলেজের সামনে থাকা ফটোকপির দোকানে নিয়ে অনেক মারধর করে রাস্তায় ফেলে দেয়।
এসময় ছাত্র-জনতার সাথে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়া,পাল্টা ধাওয়া হয়। ইট, পাটকেল ছোড়াছুড়ি হয়। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা চাপাতি, রামদাসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করলে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং কলেজের পেছন দিয়ে গিয়ে আনন্দ বাজার হয়ে ঢাকা বাসস্ট্যান্ড, আনসার অফিস, বিএডিসি ফার্ম এলাকায় গিয়ে জমায়েত হওয়ার চেষ্টা করে।
জুলাই যোদ্ধা পৃথ্বীরাজ রুদ্র বাসসকে বলেন, ‘রাষ্ট্র তখন উথালপাতাল। আব্বার কড়া নিষেধ ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না। শেষমেশ আব্বাকে বাথরুমে আটকে রেখে কোনোমতে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে ছুটলাম নেত্রকোণার দিকে। জেলা শহরে একদফার আন্দোলনে ছুটে আসছে আমার সহযোদ্ধারা’।
রুদ্র বলেন, ৩১ জুলাই আমি এবং সাবা আপা সমন্বয় করে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন-নেত্রকোণা” গ্রুপটা ক্রিয়েট করি। সাবা আপা নেত্রকোণায় ছাত্রলীগের আধিপত্য দেখে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। ৩১ জুলাই শেষ রাতের দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সেন্ট্রাল গ্রুপ থেকে আমি গ্রুপটার অনুমোদন নিই। কেন্দ্রীয় লিগ্যাল সেলের সদস্য মাহফুজ ভাই আমায় মেসেজ দিয়েছিলেন। উনার সাথে পরিকল্পনা মাফিক এগোচ্ছিলাম নেত্রকোণায় একটা সফল কর্মসূচি করার জন্য। ১ আগস্ট আমার পোস্ট দেখে মেসেজ দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি ভাই। ৩ আগস্ট খান তালাত মাহমুদ রাফি ভাইয়ের সাথে আমার সহযোদ্ধাদের নিয়ে আমি এবং সাবা আপা ভার্চুয়াল মিটিং শেষে ৪ আগস্ট নেত্রকোণা জেলা শহরে কর্মসূচির ডাক দিই। আমাদের গ্রুপে সেদিন প্রায় ১৫০০ এর অধিক মানুষ যুক্ত হয় এবং শক্তি জোগায়।
তিনি বলেন, ৪ আগস্ট সকালে আব্বাকে বাথরুমে আটকে আমি রওনা হই। সাবা আপার বাসায় গিয়ে অবস্থান নেই। সাবা আপার বাসায় যাবার পথে বিএডিসি ফার্মের সামনে আমাকে ছাত্রলীগের কর্মীরা আটকে ফোন চেক করে। ফোন চেক করে যখন নিশ্চিত হয়, আমিই পৃথ্বীরাজ রুদ্র, তখন আমার ফোনটা ছুঁড়ে মারে এবং ফোনের ডিসপ্লেটা ভেঙে যায়। শহরের পথে তখন ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের নেতাকর্মীরা অস্ত্র হাতে শোডাউন দিচ্ছে।
আমার একজন সহযোদ্ধা মাশরাফি ভাই মোক্তারপাড়ায় অবস্থান করছিলেন। মাহফুজ ভাইয়ের রোডম্যাপ অনুযায়ী আমাদের লক্ষ্য ছিল ঢাকা বাসস্ট্যান্ডের ওইদিক থেকে মিছিল নিয়ে শহরের দিকে ঢুকবো। আমাদের ডাকে নেত্রকোণা জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে সহযোদ্ধারা এসে শহরে অবস্থান করছিলো৷ কিন্তু আমরা একত্র হতে পারিনি।
ছত্রভঙ্গ অবস্থায় মোক্তারপাড়া, ডিসি অফিস, সাতপাই এরিয়া এবং ঢাকা বাসস্ট্যান্ডের আশপাশে অবস্থান করছিলো সবাই। কিন্তু ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের নেতাকর্মীদের কারণে একত্রিত হওয়ার উপায় ছিল না কোনোমতেই। সবশেষ মাশরাফি ভাই যখন জানালো শহর এখনো ছাত্রলীগের আধিপত্যে, আমি নিরুপায় হয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সেন্ট্রাল গ্রুপে একটা পোস্টের মাধ্যমে নেত্রকোণার সর্বস্তরের মানুষকে ঢাকা বাসস্ট্যান্ডে আসতে বলি। মাহফুজ ভাই পোস্ট অ্যাপ্রুভ দেন। পোস্টে মুহূর্তের মধ্যে ২০০০ এর অধিক মানুষের সাড়া দেখে আমি রাস্তায় নেমে আসার সাহস পাই৷ সাবা আপাকে নিয়ে বের হয়ে নাগড়া মীরবাড়ি রোড দিয়ে হেঁটে ঢাকা বাসস্ট্যান্ডের দিকে যেতে থাকি।
পথে এলজিইডি মসজিদের সামনে আমাদের পথ আটকায় যুবলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। জিজ্ঞাসা করে, কোথায় যাও তোমরা? সাবা আপা বলেন, স্বাধীন রাষ্ট্র। আমার যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাবো। আপনার কাছে তার জবাব দিবো না। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে ওরা আমার গায়ে হাত তুলে এবং আমার চশমাটা ভেঙে দেয়। কোনোমতে আমরা ওইখান থেকে সরে ঢাকা বাসস্ট্যান্ডে যাই। আনন্দবাজার মোড়ে একটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়ানো। ঢাকা বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে আমরা মোট আটজন একত্র হই। বৃষ্টি হচ্ছে তখন গুড়িগুড়ি। আমরা সংখ্যায় আটজন, কিন্তু তবুও আমাদের চোখে মুক্তির আলো জ্বলজ্বল করছে।
যুবলীগের নেতাকর্মীদের অস্ত্র হাতে সোডাউনটা তখন ঢাকা বাসস্ট্যান্ডের এদিকে আসে। আমি সাবা আপাকে বাসস্ট্যান্ডে রেখে পারলা বৃহৎ মাছ মাজারের দিকে যাই।
সেখানে ছাত্রদলের একটা জমায়েত ছিল। আমি তাদের সাথে মিশে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। মোটরবাইকের সোডাউনটা এদিকে আসতেই পাথর নিক্ষেপ করে তাদের উপর হামলা করি আমরা। তারা বাইক ফেলে ছুটে যায়। কিন্তু এক পর্যায়ে আমাদের এদিকে পাথর শেষ হয়ে এলে আমরা আর টিকতে পারি না। আমি আবার দৌড়ে ঢাকা বাসস্ট্যান্ডে যাই। রাস্তার পশ্চিম পাশে একটা হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন আমার বোন সাবাবা হক। আমরা ৫/৬ জনের মত আশ্রয় নেবার জন্য হোটেলের ভেতরে অবস্থান নিতে যাই৷ কিন্তু হোটেল কর্তৃপক্ষ আমাদের হোটেল থেকে বের করে দিয়ে শাটার ফেলে দেয়। নিরুপায় হয়ে আমরা রাস্তায় বের হয়ে আসি। রাজপথে কেউ নেই তখন। আমি এবং আমার বোন একা দাঁড়িয়ে ছিলাম। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি খুব খারাপ হয়ে আসে। সাবা আপা আমায় টেনে রিকশায় তুলেন। সেনাবাহিনীর গাড়ি তখন ঢাকা বাসস্ট্যান্ডের দিকে আসছে।
নাগড়া প্রাইমারি স্কুল রোডে সাবা আপার বাসায় ফেরার পথে পরিচয় হলো রিফাত ভাইয়ের সাথে। সাবা আপাকে তার বাসায় রেখে রিফাত ভাইয়ের সাথে ঢাকা বাসস্ট্যান্ড আসি। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানে। আমি অপেক্ষায় ছিলাম, এক দফার দাবিতে একটা মিছিল আসবে। মিছিলের একজন হয়ে আমিও স্লোগান দেবো, ‘লাশের ভেতর প্রাণ দে, নইলে গদি ছেড়ে দে’, ‘তোর কোটা তুই নে, লাশের ভেতর প্রাণ দে’।
আরেকজন জুলাই যোদ্ধা ফাহিম রহমান খান পাঠান বাসসকে বলেন, ‘শহরের তিনটি প্রান্তকে লক্ষ্য করে শহর ব্লক করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শহরের সাতপাই, কুড়পার ও ঢাকা বাসস্ট্যান্ড এই তিনটি এলাকায়। স্থানীয় বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ৪ আগস্টে নেত্রকোণায় আমি ঢাকা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় স্থানীয় বিভিন্ন লোকদের সাথে বের হয়ে ছাত্রলীগ, যুবলীগের সাথে সংঘাতে জড়াই এবং ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয় এক পর্যায়ে আন্দোলন থামে।’
কবি ও চিন্তক এনামূল হক পলাশ জানান ‘আমি, চিন্তক অনুপ সাদি, চিন্তক আনোয়ার হাসান প্রতিদিন ভাবতাম হাসিনা কবে যাবে। আমরা মনে করেছিলাম হাসিনাকে বিদায় করতে সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রয়োজন হতে পারে। ঢাকায় অবস্থানকারী কবি পলিয়ার ওয়াহিদ আর কবি অনার্য শান্তর সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে যাচ্ছিলাম। ৪ আগস্ট ২০২৪ তারিখ শহরের পরিস্থিতি নীরব। ছাত্ররা বিচ্ছিন্নভাবে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছিল। সারা শহরে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে টহল দিচ্ছিলো। ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেরা সায়েম আর তানভীরের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করছিলো। অপরদিকে নেত্রকোণা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল।
আমি ছাত্র ইউনিয়নকে সর্বাত্মক সহায়তা ও মানসিক শক্তি যোগাচ্ছিলাম। ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেরা গোপনে আমার সাথে উত্তরা হোটেলের সাথে একটি মার্কেটের একটি রুমে দেখা করত।
পলাশ বলেন, ‘এর মধ্যে পলিয়ার ওয়াহিদ ভাই ঢাকা থেকে জানালেন, হাসিনা সম্ভবত পলায়ন করেছে। ৪ তারিখেই আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল হাসিনা পলায়ন করেছে। আমি তখন ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেদের সুদিনের জন্য অপেক্ষা করতে বলি।’
৪ আগস্ট দত্ত স্কুল থেকে ছাত্রদের একটি দল প্রেসক্লাবের দিকে যায়। সেখানে তারা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের বাধার মুখে পড়ে। সারা শহর নীরব অথচ উত্তেজনায় টান টান। শহরের অধিকাংশ মানুষ মনে মনে হাসিনাকে পরিত্যাগ করে। হাসিনা বিরোধী চাপা ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বোঝা যাচ্ছিলো, যেকোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।