শিরোনাম
শুয়াইবুল ইসলাম
সিলেট, ৫ আগস্ট ২০২৪ (বাসস): স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে অর্জিত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি আজ। গত বছরের ৫ আগস্ট কারফিউ ভেঙে দুপুরে সিলেটের কয়েক জায়গায় মিছিল বের হলে সংঘর্ষ শুরু হয়। বেলা পৌনে ২টার দিকে তৎকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পলায়নের খবরে সিলেটে আনন্দ মিছিল বের হয়।
মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে অন্তত ৫ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে তিন জন সিলেট শহরে এবং তিন জন বিয়ানীবাজার উপজেলার পৌরশহরে গুলিতে মারা যান। সেদিন আনন্দ মিছিলের পাশাপাশি ক্ষোভের প্রতিফলন ঘটে সিলেটের বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায়।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ, মার্কসবাদী) সিলেট জেলার সমন্বয়ক সঞ্জয় কান্তি দাস বলেন, ‘সকাল থেকে সিলেট নগর ছিল অনেকটাই নিস্তব্ধ, চাপা ক্ষোভ। চৌহাট্টা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা ঘিরে ছিল টানটান উত্তেজনা। কারফিউয়ে মোতায়েন করা পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা নগরে মোতায়েন ছিল। মুখোশে মুখ ঢেকে, হাতে আধুনিক অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয় পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াট। সাজোয়া যান নিয়ে তাদের বিশাল বহর নগরে টহল দিচ্ছিল। শহীদ মিনারের সামনে তারা চারিদিক ঘিরে রাখে। আমরা চেষ্টা করেও সেখানে যেতে পারিনি। দুপুরে খবর আসে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে। এরপর শুরু হয় আনন্দ মিছিল।’
তিনি আরো বলেন, ‘শহীদ মিনারে আমরা যখন আনন্দ মিছিল করছি, তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি ঝরছে। সেই সময় আমরা আন্দোলনের সক্রিয় যোদ্ধারা দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা যাতে কোনো অপশক্তির হাতে না যায়, সেই দাবি জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছি। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে আনন্দ মিছিলের স্রোত।’
সিলেট মহানগর শিবিরের সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কারফিউ ভেঙে শহীদ মিনারের দিকে ছাত্র-জনতার একটি শান্তিপূর্ণ মিছিল অগ্রসর হলে পুলিশ গুলি চালায়। শুরু হয় সংঘর্ষ ও পাল্টা প্রতিরোধ। আমাদের হাতে প্রতিরক্ষার একমাত্র উপায় ছিল রাস্তার ইট। পুলিশ আধুনিক মারণাস্ত্র ব্যবহার করে। এতে আমাদের বহু ভাই-বোন আহত হন।’
তিনি আরো বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনের শুরুর দিক থেকে আমরা বেশিরভাগ নেতাকর্মী বাসায় ঘুমাতে পারিনি। জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের পর থেকে আমরা জীবনের মায়া ত্যাগ করেছিলাম। তবু ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের লড়াই চালিয়ে গেছি। শেখ হাসিনার পলায়নের খবর পাওয়ার পর পুলিশ আত্মসমর্পণ করে। আমাদের নেতাকর্মীরা তাদেরকে নিরাপত্তাবেষ্টনি দিয়ে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে।’
স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পতনের খবর পাওয়ার পর নেতাকর্মীরা সেজদায় পড়ে মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন এবং পরে আনন্দ মিছিলে যোগ দেন বলেও জানান তিনি।
সেদিন সকালের সংঘর্ষের এক পর্যায়ে পুলিশের গুলিতেই আহত হন এক সোয়াট সদস্য। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে আহত ওই সোয়াট সদস্যকে নেওয়া হয় সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি বিভাগে। সেখানে আগে থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার আজবাহার আলী শেখ। আগের দিন এক পুলিশ সদস্যের ছোড়া ছররা গুলিতে তিনিও আহত হয়েছিলেন।
সিলেট জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মকসুদ আহমদ বলেন, ‘বেলা সোয়া ১টার দিকে কারফিউ ভেঙে নগরের জিন্দাবাজারের তাঁতিপাড়া গলি থেকে আমরা একটি মিছিল বের করি। শহীদ মিনার ও বন্দরবাজারের দিক থেকে সেই মিছিলে যৌথ হামলা হয়। প্রায় আধা ঘণ্টাব্যাপী এই সংঘর্ষ চলে।’
সেদিন বিমানবাহিনীর একটি বিমানে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এই খবর বেলা ২টার দিকে ছড়িয়ে পড়লে সব ধর্মের ও শ্রেণি-পেশার মানুষ রাস্তায় বের হয়ে আনন্দ মিছিল করে। সিলেটে প্রচণ্ড বৃষ্টি উপেক্ষা করে মানুষের ঢল শহীদ মিনার থেকে সুরমা নদীর তীরবর্তী কিনব্রিজ পর্যন্ত পৌঁছায়। বাংলাদেশের পতাকা হাতে শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষসহ সব বয়সের মানুষ যোগ দেয় বিজয় মিছিলে।
বিকেলে মিছিলের সময় কিনব্রিজ সংলগ্ন বসতি এলাকায় কোতোয়ালি থানা পুলিশের একটি দল ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হামলা করে। সেখানে গুলিবিদ্ধ হন অনেকে। হাফিজ পাভেল আহমদ কামরুল, পঙ্কজ কুমার কর শহীদ হন সেখানে। এদিন সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় গুলিতে দুজন নিহতের খবর পাওয়া যায়। তবে, সেই তালিকা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
সেদিন সিলেটের শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্র আনন্দের বন্যা বইছিল। কারণ, এই আন্দোলন শুধু শহর নয়, সিলেটের গ্রামগঞ্জেও পৌঁছে গিয়েছিল। আগের দিন বিকেলে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায় পুলিশ, বিজিবি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলা ও গুলিতে ছয় জন প্রাণ হারান। ৫ আগস্ট গোলাপগঞ্জে শোকের আবহের মাঝে কিছুটা হলেও এলাকার মানুষকে আনন্দ দেয়। শহরজুড়ে মিছিল শুরু হয়। পাশের উপজেলা বিয়ানীবাজার পৌরশহরেও আনন্দ মিছিল বের হয়। সেখানে সেখানে গুলি চালায় আওয়ামী লীগের ক্যাডার ও পুলিশ সদস্যরা। এতে আরও তিন জনের প্রাণহানি ঘটে। নিহতরা হলেন, রায়হান আহমদ, তারেক আহমদ ও ময়নুল হোসেন। এ নিয়ে জুলাই আন্দোলনে সাংবাদিক এটিএম তুরাবসহ বিয়ানীবাজার উপজেলার পাঁচ জনকে জীবন দিতে হয়। সিলেট শহরে গুলিবিদ্ধ হয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হাফিজ পাবেল আহমদ কামরুলের বাড়ি গোলাপগঞ্জ উপজেলায়।
সেদিন কিছু মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় হামলা করে। সেসব থামাতে গিয়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া অনেকেই আহত হন। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থী, বর্তমানে এনসিপি সিলেট জেলার যুগ্ম আহ্বায়ক সালমান আহমদ খুরশেদ বলেন, ‘আমরা হাজারো ভাই-বোনের জীবন ও রক্তের বিনিময়ে শেখ হাসিনাকে হঠাতে পেরেছি। হাসিনার পলায়নের খবরে তুমুল বৃষ্টিও থামাতে পারেনি সাধারণ মানুষের উল্লাস। নারীরাও ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। শহরের প্রতিটি বাসা থেকে মানুষ রাজপথে নেমে আসে। কেউ কাঁদছে, কেউ হাসছে, কেউ উল্লাসে লাফিয়ে উঠছে। শহীদ মিনারে মিলিত হয় হাজার হাজার মানুষের ঢল। কিন্তু কোনো স্থানে কিছু বিশৃঙ্খলাকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও করছিল। আমি নিজে সেসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ক্ষুব্ধ মানুষের ইটপাটকেলের আঘাতে আহত হয়েছি।’
সেদিন নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে বিকেলে একটি পিকআপ ভ্যানে সিলেট শহরজুড়ে মাইকিং করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘জগদ্দল পাথরের মতো শক্ত এক ফ্যাসিস্টের পতনের পর মানুষের আনন্দ ও ক্ষোভ প্রকাশ পাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি তো পালিয়ে গেছেন। এদেশের অফিস আদালত, দোকানপাট, বাড়িঘর এসব আমাদের দেশের সম্পদ। তাই, এসব ক্ষতিগ্রস্ত যাতে না হয়, সেই উদ্যোগ নিয়েছিলাম। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি এবং আল্লাহর রহমতে সিলেটের মানুষের মাঝে যে সম্প্রীতি আছে তার ফলে ওইদিন ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশেই কম হয়েছে।’
রাত থেকে সিলেটের সংখ্যালঘু ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর ও ধর্মীয় উপাসনালয় পাহারার জন্য আলেম সমাজ এবং বিএনপি ও সমমনা দলের নেতাকর্মীরা এগিয়ে আসেন। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে বলে মনে করেন তিনি।