শিরোনাম
মো. আসাদুজ্জামান
সাতক্ষীরা, ৫ আগস্ট ২০২৫ (বাসস) : ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। সকাল ১০ টার পর পরই ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের একদফা দাবিতে শিক্ষার্থীদের ডাকা আন্দোলনে শহরের খুলনা রোড মোড় এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। সকালে সেখান থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়ে শহরের নিউমার্কেট ও সঙ্গীতা মোড় প্রদক্ষিণ শেষে একই স্থানে এসে অবস্থান কর্মসূচিতে মিলিত হয়।
এসময় ‘দফা এক, দাবি এক, শেখ হাসিনার পদত্যাগ’, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দিবোনা’, ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরো দিবো রক্ত’, ‘রক্তের বন্যায়, ভেসে যাবে অন্যায়’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে’, ‘ভুয়া-ভুয়া’সহ নানা ধরনের শ্লোগানে প্রকম্পিত হয় সাতক্ষীরা শহর।
আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দুপুর পৌনে দুইটার দিকে শহরে খুলনা রোড মোড়স্থ হাসপাতাল মোড় এলাকায় মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ বাধে। এতে গুলিবিদ্ধ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র নাহিদ হাসান ও সাতক্ষীরা সিটি কলেজের মেধাবী ছাত্র জিল্লুর রহমান। এরপর দুপুর আড়াইটায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার খবর শুনে ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিলে প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষের ঢল নামে।
শহরের খুলনা রোড মোড় থেকে নিউ মার্কেট মোড় পর্যন্ত শিক্ষার্থী, অভিভাবক, কৃষক, শ্রমিক, বিএনপি-জামাতসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের জনসমুদ্রে পরিণত হয়। এসময় তারা আনন্দ মিছিলে মেতে ওঠেন।
আনন্দ মিছিল শেষে বিক্ষুব্ধ জনতা বিকেলে শহরের খুলনা রোড মোড়ে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ম্যুরাল ভাঙচুর করে। শহরের পাকাপোলের মোড় সংলগ্ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদে আগুন দেয় এবং শহরের পোস্ট অফিসের জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভাঙচুর করে।
এদিন সন্ধ্যায় বিক্ষুব্ধ জনতা সাতক্ষীরা সদর থানার দিকে গেলে পুলিশ থানার ভেতর থেকে রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করলে এসময় বেশ কয়েকজন আহত হন। পরে পুলিশ সদস্যদের থানা থেকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়। এরপর একদল দুর্বৃত্ত থানা ভাঙচুর ও লুটপাট করে। ওই রাতে জেলার শ্যামনগর ও কলারোয়া থানায়ও হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা।
জেলা পুলিশ কার্যালয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর খবরে আশাশুনির প্রতাপনগরে ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিলে আওয়ামী লীগের নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেনের গুলিতে নিহত হন ৩ জন। এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ জনতার গণপিটুনিতে জাকির চেয়ারম্যানসহ আরো ৬ জন মারা যান।
আওয়ামীলীগ নেতা জাকিরের ছোড়া গুলিতে নিহত আলম সরদারের স্ত্রী আসমা খাতুন বাসসকে বলেন, আমার স্বামীর নাম আলম সরদার। তাকে গুলি করে হত্যা করে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন। আমার তিনটি বাচ্চা। তাদের নিয়ে আমি খুব কষ্টে আছি। তিনি এসময় তার পরিবারটি যাতে টিকে থাকতে পারে সেজন্য সরকারের কাছে তাদের পুনর্বাসনের দাবি জানান।
প্রতাপনগরে নিহত হাফেজ আনাস বিল্লাহর বড় ভাই আরিফ বিল্লাহ বাসসকে বলেন, শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার খবর শুনে গত বছরের এই দিনে প্রতাপনগরের ছাত্র-জনতা স্থানীয় তালতলা বাজারে একটি আনন্দ মিছিল বের করে। এই মিছিলে আমার ভাইসহ তার বন্ধুরা যোগ দেয়। মিছিলটি ফুলতলা বাজার ও কল্যাণপুর বাজার হয়ে নাকনা গ্রামের স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা ও সাবেক চেয়ারম্যান জাকির হোসেনের বাড়ির সামনে গেলে আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনী ওই শান্তিপূর্ণ আনন্দ মিছিলকে লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু গুলি ছোড়ে। এতে আমার ভাই আনাস বিল্লাহসহ তিন জন নিহত ও কয়েকজন আহত হন।
তিনি বলেন, আমার ভাইয়ের শরীরে মোট তিনটি গুলি লাগে। এর মধ্যে একটি গুলি তার তলপেটের ভিতরে ঢুকে কিডনিতে লাগে। আরেকটি গুলি তার বুকে ও অপরটি তার ডান হাতে লাগে। এতে তার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। একপর্যায়ে তাকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। আমার এই ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর শোক দরিদ্র পিতামাতাসহ আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
জুলাই আন্দোলনে জেলার অন্যতম সংগঠক আল ইমরান ইমু বাসসকে বলেন, কেন্দ্রীয় সমন্বয়করা হঠাৎ করেই আগের দিন রাতে ৫ আগস্ট ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ ঘোষণা দেন এবং আমাদের ঢাকায় যাওয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু সাতক্ষীরা থেকে ঢাকা অনেক দূর হওয়ায় আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম সাতক্ষীরাতেই আমরা এ কর্মসূচি পালন করবো।
শহরের খুলনা রোড মোড়ে সকাল ১০ টার পর থেকেই কর্মসূচি শুরু হয়ে যায়। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত আমরা বাসায় ফিরে যাবো না।
আবেগাপ্লুত কণ্ঠে ইমু বলেন, সেদিন দুপুর ১টায় আমরা শহরের খুলনা রোড মোড়ে জোহরের নামাজ শেষে মোনাজাতে অঝোরে কেঁদেছিলাম যাতে স্বৈরাচারের পতন হয়।
এরপর পৌনে দুই টার দিকে খবর পাই হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। কিন্তু আমরা জাতির উদ্দেশ্যে সেনা প্রধানের ভাষণের অপেক্ষায় ছিলাম। ইতোমধ্যে আমাদের কায়েকজনের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ গুলি চালায় ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এতে নাহিদ হাসান ও জিল্লুর রহমান নামের দুই জন গুলিবিদ্ধ হন। সাথে সাথে তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর আড়াইটার দিকে আমরা শেখ হাসিনার পালানোর খবর নিশ্চিত হই। তারপর শুরু হয় বিজয়ের উৎসব। উৎসব পরিণত হয় জনসমুদ্রে।
জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক আরাফাত হোসাইন জানান, জুলাই আন্দোলনে আমাদের সাতক্ষীরায় ১০৭ জন ছাত্র-জনতা আহত হয়েছেন। যারা গেজেটভুক্ত। আর ৫ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ৪ জন গেজেটভুক্ত হয়েছেন। আহতদের জুলাই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ১ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে চিকিৎসা বাবদ। আর শহীদ পরিবারকে ৫ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। আপনারা জানেন, আহত ও নিহতদের পাশে দাঁড়ানো অন্তর্বতী সরকারের একটি ম্যান্ডেট রয়েছে। আমাদের দাবি, আগামীতে যে সরকারই আসুক না কেন, জুলাই যোদ্ধাদের যেন অবহেলা না করা হয়। আর তাদের যেন আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়। যাতে তারা ভালোভাবে জীবন অতিবাহিত করতে পারে।
সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ তারিকুল হাসান বাসসকে বলেন, গত ১৭ বছর যাবত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছি। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুখ্যানে। বিএনপি ও তার অঙ্গসহযোগী সংগঠন ছাত্র, যুবদলসহ অন্যসংগঠনের নেতাকর্মীরা এই আন্দোলনে সম্মুখ সারিতে থেকে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। আমরা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছি। আমাদের সাথে সাধারণ ছাত্র-জনতা রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে।
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কৃষ্ণা রায় বলেন, আশাশুনির প্রতাপনগরে তিনজন জুলাই যোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। উপজেলা প্রশাসন সব সময় তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করে। এছাড়া জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সরকারি যে সহযোগিতা, তা আমরা তাদের দিয়ে থাকি। শহীদ পরিবারের যে কোন সমস্যা সমাধানে উপজেলা প্রশাসন কাজ করবে।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ শোয়াইব আহমাদ বাসসকে বলেন, সাতক্ষীরায় ৪ জন জুলাই আন্দোলনে নিহত হয়েছেন। এরমধ্যে তিন জন আশাশুনির প্রতাপনগরের। অপরজন আসিফ হাসান ঢাকাতে শহীদ হয়েছেন। এছাড়া অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছে। আহত ও নিহতদের জেলা প্রশাসন ও সরকারের পক্ষ থেকে সবধরনের সাহায্য সহযোগিতা করা হচ্ছে। আগামীতেও এটা অব্যাহত থাকবে।