বাসস
  ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১৮:৩৩

এখনো সন্ধান মিলেনি পঞ্চগড়ের নিখোঁজ আলামিনের

ছবি: বাসস

আবু নাঈম

পঞ্চগড়, ৫ আগস্ট ২০২৫ (বাসস): ছোটবেলা থেকে আলামিন বেড়ে ওঠেন পালিত বাবা-মায়ের কাছে। জীবন যুদ্ধে ছিলেন সংগ্রামী। এ কারণেই হয়তো সামান্য ইজিবাইকচালক হয়েও অংশ নিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনে। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে এক দফা, পুরো আন্দোলনেই ছিলেন সরব। এরপর স্বৈরাচার পতনের মধ্য দিয়ে যেন আত্মতুষ্টি পেয়েছিলেন ২৮ বছরের এই যুবক। কিন্তু সেদিনের পর কি ঘটেছিলো আলামিনের ভাগ্যে? কোথায় আছেন তিনি- এই প্রশ্নের উত্তর আজও পাননি সহযোদ্ধারা।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই নিখোঁজ আলামিন। একবছরেও তার সন্ধান মিলেনি। বেঁচে আছেন কি-না তাও জানে না পরিবার। তবে অভিযোগ উঠেছে, হত্যার পর আলামিনের লাশ গুম করেছে ঘাতকরা। এতে সরাসরি জড়িত জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান সাকিব পাটোয়ারী প্লাবন।

আলামিন বেড়ে ওঠেন পঞ্চগড় পৌর শহরের উত্তর দর্জিপাড়া গ্রামে। তার পালিত বাবার নাম মনু মিয়া। খুব ছোট বেলায় নিঃসন্তান মনু মিয়া তাকে দত্তক এনেছিলেন। তখন থেকেই তার পরিচয় মনু মিয়ার ছেলে। আলামিন ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত, তার ৪ বছর বয়সি একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। সেই সন্তানকে আঁকড়ে এখনো স্বামীর অপেক্ষার প্রহর গুণছেন তার স্ত্রী সুমি আক্তার।

জানা গেছে, আলামিনকে হত্যার পর লাশ গুম করা হয়েছে- এমন অভিযোগে গতবছরের ১০ নভেম্বর সাবেক রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে পঞ্চগড় সদর থানায় মামলা করেন মনু মিয়া।

মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, আলামিন পেশায় ইজিবাইকচালক ছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এজন্য আন্দোলনের শুরু থেকেই তাকে হুমকি দেওয়া হতো। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর আলামিন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান সাকিব পাটোয়ারী প্লাবনের বাড়ির সামনে দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। তখন কতিপয় আসামির পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ মদদে অন্য আসামিরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আলামিনকে জখম করে। এতে আলামিন লুটিয়ে পড়লে তারা দেহটি টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। তখন থেকেই আলামিনের সন্ধান নেই।

এদিকে, আলামিন হত্যাকাণ্ডের শিকার এবং তার লাশ গুম করা হয়েছে- বলে মামলা চলমান থাকলেও জুলাই আন্দোলনের শহীদ তালিকায় তার নাম ওঠেনি। স্বীকৃতি পাননি জুলাই যোদ্ধা হিসেবেও। ফলে সরকারি-বেসরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধাও পায়নি তার পরিবার। 

অন্যান্য শহীদ ও আহতদের পরিবারদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে বিভিন্নভাবে সহায়তা দেয়া হলেও এখনো বঞ্চিত রয়েছে আলামিনের পরিবার।

আলামিনের শ্বশুর বাড়ি পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের আমবাড়ি গ্রামে। বর্তমান তার স্ত্রী-সন্তান এখানেই থাকছেন। সম্প্রতি ওই বাড়িতে কথা হয় সুমি আক্তারের সঙ্গে। এ সময় সুমি আক্তারের কোলে ছোট্ট শিশু কন্যা আফরিন। চার বছরের অবুঝ এই শিশু চারপাশে যেন শুধু খুঁজে ফিরছে বাবার মুখ। 

উত্তর দর্জিপাড়া গ্রামে আলামিনের বাড়িতেও সুনসান নিরবতা। অসুস্থ মনু মিয়ার একমাত্র অবলম্বন ছিল আলামিন। বাড়ি ভিটার সামান্য জমিটাও দিয়ে রেখেছেন ছেলের নামে। সেই ছেলে আজ একবছর হলো নেই। প্রতিবন্ধী স্ত্রী রুনা আক্তারকে নিয়েই এখন তার সংসার। এ অবস্থায় ছেলের কথা মনে পড়লেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। ঘরে যত্ন করে রাখা আলামিনের ছবি বের করে দেখেন। তবে তিনি মনে করেন, আলামিন এখনো বেঁচে আছে, তার কাছে ফিরে আসবে।

আলামিনের স্ত্রী সুমি আক্তার বলেন, আমার স্বামী ছাত্রজনতার আন্দোলন থেকে একবছরেও ফিরেনি। বেঁচে আছে কি-না জানি না। মারা গেলে তার লাশটা পেলে অন্তত দাফন করে বলতে পারতাম, এটা আমার স্বামীর কবর। সন্তান বড় হলে তাকেও তার বাবার কবর দেখাতে পারতাম।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, যারা শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারে যেমন শূন্যতা, আমার পরিবারেও তেমন শূন্যতা। কিন্তু সব শহীদের পরিবার যেভাবে সম্মানিত হলো, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পেলো- আমরা পাইনি। এখন সন্তান নিয়ে খুব কষ্টে দিনাতিপাত করছি। হতাশা আর দুশ্চিন্তা নিত্যসঙ্গী। আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ কি, কোন পরিচয়ে বেড়ে ওঠবে? যদি সত্যিই আমার স্বামী মারা গিয়ে থাকে, তাহলে তাকে শহীদ স্বীকৃতি দেয়া হোক। অন্তত আমার মেয়েটা জুলাই আন্দোলনে শহীদের সন্তান পরিচয়ে বড় হবে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকালীন পঞ্চগড়ের সমন্বয়ক ফজলে রাব্বী বলেন, আলামিন আমাদের সহযোদ্ধা ছিলেন। একবছরেও তার নিখোঁজের রহস্য উদ্‌ঘাটন হয়নি- এটা দুঃখজনক। যদিও আমরা বিভিন্নভাবে জেনেছি তাকে হত্যার পর লাশ গুম করা হয়েছে। এ জন্য আমরা বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছি তাকে জুলাই যোদ্ধার প্রাপ্য সম্মান নিয়ে দিতে। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন- এটা অফিসিয়ালি  নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে তা সম্ভব হয়নি। এরপরও আমাদের দাবি- একবছর ধরে পরিবারে তার অনুপস্থিতি যে সংকট তৈরি করেছে, সেই সংকট লাঘবে সরকার যেন উদ্যোগ নেন।