বাসস
  ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১৭:৪২
আপডেট : ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১৮:৫২

দীর্ঘ আতঙ্কের পথ পাড়ি দিয়ে মেহেরপুরে স্বস্তি নেমে আসে 

ফাইল ছবি

দিলরুবা খাতুন

মেহেরপুর, ৫ আগস্ট ২০২৫ (বাসস) : ৫ আগস্ট ২০২৪। ভোর থেকে শহরজুড়ে এক অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছিল। সাধারণ পাখির ডাক, শহরে চলাচলের ব্যস্ততা থাকলেও মানুষের চলাচল ছিল খুবই কম। বাতাস ভারি ছিল। আকাশও খানিকটা মেঘলা ছিল। যেন প্রকৃতি নিজেই জানত কিছু একটা ঘটতে চলেছে। অনেকেই ঘর থেকে বের হননি। সোশ্যাল মিডিয়ায় রাতেই গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে ঢাকার দিক থেকে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর মেহেরপুর সীমান্তবর্তী হওয়ায় আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়। 

এদিকে স্থানীয় সরকারদলীয় নেতারা সতর্কবার্তা  দেয় , ‘ঘর থেকে অপ্রয়োজনে কেউ বের হবেন না। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে পারে।’ 

সেদিন শহর ঘুরে দেখা যায়, দোকানপাট বেশিরভাগই বন্ধ। শুধু কিছু নিত্যপণ্যের দোকান খোলা ছিল কিছুক্ষণের জন্য। রাস্তায় পুলিশের টহল ছিল অস্বাভাবিকভাবে দৃশ্যমান। কিছু জায়গায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)’র সদস্যদের ও দেখা যায়। এটি কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতি ছিল না। 

প্রতিদিনের মত সেদিনও সকালে মেহেরপুর জেলা শহরের মল্লিক পাড়ার চায়ের দোকানদার কিতাব আলীর এক হাতে কেটলি ধরা, অন্য হাতে টিভির রিমোট। স্ক্রিনে তখন যমুনা টেলিভিশনে স্টিকারে খবর ভেসে উঠছে, ‘ঢাকার চানখারপুলে গোলাগুলিদে নিহত ৫।’ চা ফেলে দিয়ে তিনি বলে ওঠেন, ‘আরে ভাই, আমরা কি আজ রেহাই পাব?’তখনই পেছন থেকে একজন সাবধান বাণী উচ্চারণ করেন, ‘পরিস্থিতি বিবেচনায় সবাই ঘরে চলুন, শান্তি রক্ষা করি।’ 

বেলা ১২টার দিকে হঠাৎ করেই শহর অবস্থান নেয়া ও টহলে থাকা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পাততাড়ি গুটিয়ে দ্রুতগতিতে থানায় কিংবা পুলিশ লাইনে  চলে যায়। সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের বোবা আতঙ্ক— ‘কী জানি কী হয়! কিংবা কী হয়েছে এমন এক অনুভূতি! 

দুপুরের দিকে গুঞ্জন রটে যায় শেখ হাসিনা আর ক্ষমতায় থাকছেন না। টেলিভিশনের স্ক্রলে দেখা যায় সেনাবাহিনী প্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। তখন জনসাধারণের মধ্যে আলোচনা শুরু হয় শেখ হাসিনা আর ক্ষমতায় থাকছেন না। ছাত্র জনতার আন্দোলন সফল হতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে খবর আসে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা এবং তার ছোট বোন শেখ রেহানা ইন্ডিয়ায় পালিয়ে গেছে। জনগণ টেলিভিশনের সামনে অপেক্ষা করছে সেনাবাহিনীর ভাষণের অপেক্ষায়। অবশেষে সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন।

জনগণের মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। সেনাপ্রধানের ভাষণের পর শহরে আনন্দ মিছিল করতে থাকে ছাত্র জনতা।  বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে শহরে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। উৎসবের নগরীতে পরিণত হয় মেহেরপুর। 

এরই মধ্যে সন্ধ্যায় একশ্রেণির মানুষ লুটতরাজে মেতে ওঠে। রাস্তার পাশে ফুটপাথের ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করেন সন্ধ্যার পর লুটতরাজ হতে পারে। তারা তাদের ব্যবসা সরিয়ে নেন। মাগরিবের নামাজের শেষে নির্যাতিত মানুষ ফ্যাসিবাদীদের বাড়ি-ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ধ্বংসাবশেষে লুটপাট ও আগুন দেয়া শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এদিন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা ঘর-বাড়ি ছেড়ে, পরিবার নিয়ে পালিয়ে যায়। অনেক পরিবার নির্ঘুম রাত পার করে। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয় বেশ কয়েকটি বাড়িতে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের খুব কাছের মানুষ যে-সব ফ্যাসিস্ট নেতারা রাষ্ট্রের সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করেছে তাদের বাড়িতে কোন ধরনের হিংসার আঁচড় পড়েনি। যা বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।  এদিন থেকে বেশ কয়েকদিন সড়কে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোন কর্মকর্তা ও সদস্যকে পথে দেখা যায়নি। সরকারি অফিস আদালতের প্রধান ফটকে ভেতর থেকে তালা লটকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। 

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত মো. হাসনাত জামান (১৯) বলেন, দেশে কোটা বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে মা আপত্তি তোলে আন্দোলনে যেতে। মাকে অনুরোধ করে বোঝাই আমাদের মতো যুবকেরা দেশের দুঃসময়ে সাড়া না দিলে দেশ শেষ হয়ে যাবে। এক সময় চোখের পানিতে আমাকে আজকের আন্দোলনে যাবার অনুমতি দেন মা। ৫ আগস্ট সকাল ১১ টার দিকে বাড়ি থেকে রওনা দিই শহরের দিকে। কারফিউ চলার কারণে মেহেরপুর স্টেডিয়াম মোড় পর্যন্ত পৌঁছানোর পর আর ভিতরে ঢুকতে পারি না।

সেখানেই ছাত্রলীগের ছেলেরা রড, পাইপ দিয়ে সারা শরীরে আঘাত করে। সেখানে নির্যাতন চালানোর পর তারা আমাকে পুলিশে সোপর্দ করে। থানায় আটক থাকার পর যখন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দেশ  ছেড়ে চলে যায় এরপর আমাকে ছেড়ে দেয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা মেহেরপুরের খন্দকার মুইজ উদ্দিন বলেন, সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন বেগবান হয়ে উঠলেও মেহেরপুরে কোনো কিছু করা সম্ভব হচ্ছিল না। মেহেরপুরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কম। আমাদের রাস্তায় দাঁড়ানোর মত পরিবেশ ছিল না। শিক্ষার্থীরাও তেমন মাঠে নামতে চায়নি। ৫ আগস্ট আমরা মেহেরপুর প্রেসক্লাবের সামনে একটা সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিই। সেই মোতাবেক ৫ আগস্ট সকালে প্রেসক্লাবের সামনে যাই। পরিস্থিতি প্রতিকূল হওয়ায় সেখান থেকে চলে আসি।

ফেরার পথে হালদার পাড়া থেকে একটা ফোন আসে। ফোন পেয়ে সেখানে ছুটে যাই। সেখানকার পরিবেশ শান্ত মনে হওয়ায় বড় বাজারের দিকে আসার সময় হালদারপাড়া পার হচ্ছি তখনই ৭-৮টা মোটরসাইকেল আমার রিকশা ঘিরে ফেলে। সাথে সাথে রিকশা থেকে নামিয়ে রড, লোহার পাইপ , হাতুড়ি দিয়ে আমার পুরো শরীরে আঘাত করে। 

সেদিনের দুর্বিষহ স্মৃতি স্মরণ করে মুইজ উদ্দিন বলেন, এরইমধ্যে পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে লাঠিয়াল বাহিনী তাদের লাঠিসোঁটা আমার ব্যাগে ভরে দেয়। আমার কাছে লাঠিসোঁটা দেখে পুলিশ আমাকে আটক করে নিয়ে যায়। থানায় গিয়ে আরও বেশ কয়েকজনকে দেখতে পাই। একপর্যায়ে সবাইকে ছেড়ে দেয়।

আমাকে বিকেল তিনটার দিকে পুলিশের পিকআপে করে কোর্টের দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় মাঝপথে থেমে যায়। আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাড়িতে খবর দিতে বলে। পরে অবশ্য পুলিশই আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়। তারপর হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে আউট ডোরে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। এক দীর্ঘ আতঙ্কের পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের জীবনে স্বস্তি নেমে আসে।