বাসস
  ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১৬:৫৯

মার্চ টু ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে শহীদ হন স্বজন

ফাইল ছবি

নুসরাত সুপ্তি

নারায়ণগঞ্জ, ৫আগস্ট,২০২৫(বাসস) : চব্বিশের ৫ আগস্ট, ছাত্র-জনতার সেই ৩৬ জুলাই। রক্তস্নাত সেই বিজয়ের দিন ফিরে এসেছে। ছাত্র, শ্রমিক ও সকল শ্রেণির পেশার মানুষের  সম্মিলিত আন্দোলনে শাসকের মোড়কে জড়িয়ে থাকা এক দানবরূপী স্বৈরাচারের অবসান হয়েছিল সেদিন। রাজধানী ঢাকার ন্যায় নারায়ণগঞ্জেও দিনভর চলেছে সংঘর্ষ। 'মার্চ টু ঢাকা'র উদ্দেশ্য বেরিয়ে শহীদ হয়েছেন বন্দর উপজেলার কুশিয়ারা এলাকার আবুল হাসান স্বজন।

আন্দোলনকারীদের  তেজের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো জেলায়। ভোর হওয়ার আগেই খণ্ড খণ্ড হয়ে ঢাকার উদ্দেশে পথে নামে ছাত্র-জনতা। সাইনবোর্ড থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে অনেককেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ফিরিয়ে দেয়। ঢাকামুখী ছাত্র-জনতা বিকল্প পথ ধরে এগিয়ে চলে। কেউ ঢাকা- নারায়ণগঞ্জ পুরাতন সড়ক, কেউবা ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার সড়ক দিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা হয়।

এদিকে জেলা শহরে সেদিন সকাল থেকে ওৎপেতে ছিল আওয়ামী ক্যাডার বাহিনীর সন্ত্রাসীরা। আন্দোলন ঠেকাতে তারা চাষাড়া ও তার আশেপাশের স্থানে অবস্থান  নেয়। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা রূপায়ণ টাওয়ারে অয়ন ওসমানের কার্যালয়ে জড়ো হতে থাকে ।

সকাল দশ টার পরেই চাষাড়ায় কয়েকশ ছাত্র- জনতা জড়ো হতে থাকেন। এরমধ্যে ঢাকা যেতে বাধা দিলে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে ।

বেলা বারো টার দিকে পুলিশের সঙ্গে যুক্ত হয় শামীম ওসমানের অনুসারী যুবলীগ নেতা শাহাদাৎ হোসেন, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জুয়েল হোসেন ও শামীম ওসমানের ছেলে ইমতিনান ওসমান অয়নের অনুসারী অস্ত্রধারী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তারা আন্দোলনকারীদোর ওপর গুলি চালান।  এসময় চাষাড়া চত্বর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সেদিন কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন। তাদের মধ্যে একজন  যুবদল সদস্য শহীদ আবুল হাসান স্বজন।

স্বজনের মৃত্যু পূর্ববর্তী শেষ স্মৃতি স্মরণ করে স্বজনের ভাই  অনিক বলেন, " স্বজনের গায়ে গুলি লাগলে আমরা ওরে প্রথমে ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালে নেই, সেখান থেকে ফিরিয়ে দিলে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাই। পথে স্বজন আমারে বলে ‘ভাইরে আমি কি মারা যামু? আমারে বাঁচা। তখন আমি ওরে ধমক দিয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু ভাই আমার বুঝছিল, সে আর বাঁচবে না। মৃত্যুর আগেও আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, খুনি হাসিনা কি পদত্যাগ করছে? আর শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার কথা শুনে মুচকি হাসি দিয়ে বলেছিল, ‘আলহামদুলিল্লাহ’।

তিনি বলেন, একাধিক সড়ক ঘুরে আমরা চাষাড়া এসে পৌঁছেছিলাম সেদিন। স্বজনের নেতৃত্বেই এখানে আসি আমরা। এরমধ্যে  পুলিশ এসে টিয়ারশেল, শর্টগানের গুলি ছুড়ে। তখন পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। এরমধ্যে আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসীরা ছাত্রদের উপর হামলা করে। তখন আমরা সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। পরে ২ টার দিকে ফোন আসে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে। ফোন ধরতেই জানতে পারি স্বজনের গায়ে গুলি লাগছে।

ঢাকা মেডিকেলে তিনবার এক্সরে করে স্বজনের গুলির স্থান শনাক্ত করা হয়। রাতে তার অপারেশন শুরুর ৬ ঘণ্টা পর অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করা হয় স্বজনকে। কেবিনে দেওয়ার তিনঘণ্টা পরে ওর জ্ঞান ফিরে স্বজনের,  কিছুক্ষণ পরে আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে । এরপর আর জ্ঞান ফিরেনি স্বজনের।  সেদিন বিকালে মারা যায় স্বজন।

৫ আগস্ট কেবল স্বজন নয়, মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে  নারায়ণগঞ্জের আরো ৬ জন বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলন করে  শহীদ হন। তারা হলেন - শহীদ ইমরান হাসান, শহীদ মোহাম্মদ সাইফুল হাসান, শহীদ পারভেজ হাওলাদার, শহীদ সফিকুল, শহীদ সুলাইমান, শহীদ বিল্লাল।

এদিকে দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। চাষাড়া ত্যাগ করে পুলিশ। এক পর্যায়ে ছাত্র জনতার প্রতিরোধের মুখে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরাও পালাতে বাধ্য হয়। আওয়ামীলীগের ঘাটি খ্যাত রাইফেলস ক্লাবে অগ্নিসংযোগ, শামীম ওসমানদের বাড়িতে ভাঙচুর করে বিক্ষুব্ধ জনতা।

শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবরে শহর ও শহরতলিতে মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ে। শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সের, শ্রেণি পেশার হাজারো মানুষ জাতীয় পতাকা হাতে বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেন। চাষাড়ার বিজয়স্তম্ভ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। শুরু হয়ে যায়, 'পলাইছে রে পলাইছে, শেখ হাসিনা পলাইছে' স্লোগান।  লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে মুক্ত বাতাসে স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করেন নারায়ণগঞ্জের সংগ্রামী জনতা।

এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সদস্য সচিব ও জেলার মুখ্য সমন্বয়কারী এ্যাড. আব্দুল্লাহ আল আমিন নারায়ণগঞ্জের রক্তক্ষয়ী আন্দোলন সংগ্রামের বিষয়ে বলেন,  ‘দুই হাজার ছাত্র-জনতার জীবন এবং ৩০ থেকে ৩৫ হাজার আহত ভাইয়ের পঙ্গুত্বের বিনিময়ে আমরা নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। এই লড়াইয়ে নারায়ণগঞ্জের অবদান ব্যাপক। আন্দোলনের দিনগুলোতে প্রতিরোধ, সংঘর্ষ, রক্তপাত ও প্রাণ বিসর্জনের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জ শহর ও তার আশেপাশের জনপদ হয়ে উঠেছিল প্রতিরোধের দুর্গ।

তিনি আরও বলেন,  এই নতুন বাংলাদেশকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন।  সেই লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে চলছি কিন্তু ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসররা নারায়ণগঞ্জে এখনও সক্রিয় আছে এবং তারা বিভিন্নভাবে অপতৎপরতা চালানোর চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে জেলার ব্যবসায়ী মহল ও রাজনৈতিকভাবে তাদেরকে পুনর্বাসনেরও চেষ্টা করা হচ্ছে। তাই ফ্যাসিস্টদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে।

জুলাই আন্দোলনে অগ্নিগর্ভ  ছিল নারায়ণগঞ্জ। ৫ আগস্ট চূড়ান্ত বিজয়ের আগ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে ৫৫টি তাজা প্রাণ ঝড়ে যায়।

এসব শহীদদের রক্তের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদের দীর্ঘ শাসনের পতন ঘটে। তাদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন ২১ জন। নারায়ণগঞ্জের শহীদদের স্মরণে জেলার সদর উপজেলার  হাজীগঞ্জ এলাকায় নির্মিত হয়েছে  দেশের প্রথম ‘জুলাই শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ’।