বাসস
  ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১৬:২৪
আপডেট : ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১৬:৫১

কুমিল্লায় স্বৈরাচার পতনে ছাত্র-জনতার উল্লাস, বিজয়ের দিনে নিহত ৪

ফাইল ছবি

দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ

কুমিল্লা, ৫ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস): কুমিল্লায় দ্বিতীয় দিনের অসহযোগ আন্দোলন (৫ আগস্ট) ছিল রক্তাক্ত। তবে শেষ বিকেলে নেমে আসে বিজয়ের উচ্ছ্বাস। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ডাকা আন্দোলনের দ্বিতীয় দিনে জেলার চৌদ্দগ্রাম, দেবিদ্বার, দাউদকান্দিসহ বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও গুলি বিনিময়ের ঘটনায় চারজন নিহত এবং অর্ধশতাধিক আহত হন।

গত কয়েকদিনের আন্দোলনে কুমিল্লায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় আটজনে। তবে কুমিল্লা জেলা গণঅভ্যুত্থান স্মারক কমিটির তথ্যানুযায়ী, ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জেলায় সংঘর্ষে এই জেলার আরও ৩০ জন বাসিন্দা প্রাণ হারান। নিহতদের অধিকাংশই ছাত্র, শ্রমিক ও দিনমজুর ছিলেন।

বিকেল ৪টায় জাতির উদ্দেশে টেলিভিশন ভাষণে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘জনতার দাবির মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে। সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার করা হবে।’

এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই কুমিল্লা শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত উল্লাসে ফেটে পড়ে জনতা। রাজপথে, অলিগলিতে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, ‘স্বৈরাচার হাসিনা পালিয়েছে’, ‘ভুয়া হাসিনা ভুয়া’, ‘ছি ছি হাসিনা, লজ্জায় বাঁচি না’- ইত্যাদি স্লোগান।

কুমিল্লা নগরীর শাসনগাছা, কান্দিরপাড়, চকবাজার, টমছমব্রিজসহ প্রধান সড়কগুলো ছাত্র-জনতা ও সাধারণ মানুষের দখলে চলে যায়। ছাত্র-ছাত্রী, রাজনৈতিক কর্মী, পেশাজীবী, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হাজারো মানুষ বিজয় মিছিলে অংশ নেয়। শহরের প্রতিটি মোড়, পাড়া-মহল্লায় ঢোল-তবলার তালে আনন্দ-উৎসব ছড়িয়ে পড়ে।

৫ আগস্টের সংঘর্ষে নিহত হন চারজন। তারা হলেন; চৌদ্দগ্রাম থানার সামনে পুলিশের গুলিতে জামসেদুর রহমান, দেবিদ্বারের মাটিয়া মসজিদ এলাকায় আমিনুল ইসলাম সাব্বির, দাউদকান্দি থানার সামনে মো. বাবু এবং গৌরীপুর বাজারে মো. সুলতান আহম্মেদ। এর আগে ৪ আগস্ট শহীদ হন রিফাত হোসেন, রুবেল মিয়া, মাছুম মিয়া এবং ৩ আগস্ট আহত হয়ে ৭ আগস্ট মারা যান মো. মিলন মিয়া।

ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে পুলিশের গুলিতে ও সরকারি দলের অস্ত্রধারীদের হামলায় কুমিল্লার আরও ৩০ জন আন্দোলনকারী প্রাণ হারান। এদের অধিকাংশই বৈষম্যমূলক আঞ্চলিক কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ ছিল, এই কোটা নীতির কারণে কুমিল্লাসহ দেশের অনেক অঞ্চলের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা অবিচারের শিকার হচ্ছেন।

কুমিল্লা মহানগর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সদস্য সচিব মুহাম্মাদ রাশেদুল হাসান জুলাই আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করে বাসসকে বলেন, ‘৫ আগস্ট সকালেই সাইফুল ভাইয়ের সহায়তায় ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছাই। তখন সারাদেশে কারফিউ এবং ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। সমন্বয়ক আবু রায়হান ভাইয়ের সাথে শেষবার যখন কথা হয় তখন তিনি কোটবাড়িতে ছাত্রলীগের হাতে জিম্মি। পরে আরিফুজ্জামান ভাই আমাকে কালা কচুয়া পৌঁছে দেন। সেখানেও কাউকে পাচ্ছিলাম না। অবশেষে আকিব আব্দুল্লাহর মাধ্যমে নাজিরা বাজারে অবস্থানরতদের সাথে সংযুক্ত হই।’

তিনি বলেন, ‘দুপুর দেড়টায় দেখি বিএনপি-জামায়াতের কর্মসূচিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কম। যোহরের নামাজের পর শুনি, ‘শেখ হাসিনা পালিয়েছে’ বিদেশ থেকে এমন বার্তা আসছে। অস্ট্রেলিয়া থেকে এক ভাই ফোন দিয়ে বললেন, তোমরা ইতিহাস গড়েছো!' তখনই বুঝে যাই, আমাদের জয় নিশ্চিত হয়েছে।’

স্মৃতিচারণে রাশেদ আরও বলেন, ‘তারপরই শুরু হয় স্বাধীনতার আনন্দ উদ্‌যাপন। আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া জানাই, আমাকে এই আন্দোলনের সাক্ষী করার জন্য। ইনকিলাবের কর্মী হয়ে গাজি হওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য।’

শহীদ পরিবারের সদস্যরা বাসসকে জানান, নিহতদের অধিকাংশের হত্যাকারীরা এখনো আইনের আওতায় আসেনি। শহীদ সুলতানের স্ত্রী বলেন, ‘আমার স্বামী মানুষের অধিকারের কথা বলার জন্য আন্দোলনে গিয়েছিল। আজও তার খুনিরা ধরা পড়েনি।’

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোহাম্মদ হায়দার আলী বাসসকে বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনে কুমিল্লার ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। আমাদের শিক্ষার্থীরা ছিলেন আন্দোলনের সামনের সারিতে। তাদের ত্যাগ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শফিকুল আলম হেলাল বলেন, ‘এই আন্দোলন ছিল একটি নতুন প্রজন্মের ন্যায়বিচারের সংগ্রাম। ছাত্র-জনতার রক্ত বৃথা যায়নি।’

কুমিল্লা জেলা প্রশাসন ও গণঅভ্যুত্থান স্মারক কমিটির উদ্যোগে ২০২৫ সালের ২৬ জুলাই শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে নির্মাণ করা হয়েছে ‘গণঅভ্যুত্থান স্মারক স্তম্ভ’। প্রতি বছর ৫ আগস্ট ‘কুমিল্লা গণঅভ্যুত্থান দিবস’ হিসেবে পালিত হবে।

এদিকে, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিতে ১১ জুলাইকে ‘জুলাই আন্দোলনের প্রথম প্রতিরোধ দিবস’ ঘোষণা করেছেন স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া।

গত ১১ জুলাই বিকেলে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে আয়োজিত ‘প্রতিরোধ দিবস’ স্মৃতির মিনার অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘১১ জুলাই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তা সারাদেশের আন্দোলনকারীদের সাহস জুগিয়েছিল। তাদের সেই ব্লকেড ও প্রতিরোধ স্বৈরাচারী সরকারের পতনের ভিত্তি তৈরি করে।’


উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ আরও বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধস্থলে ‘প্রতিরোধ মিনার’ স্থাপন করা হবে এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জুলাই মিনার’ নির্মাণ করা হবে।’ অনুষ্ঠানে তিনি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য তিনটি বাস উপহার দেওয়ার ঘোষণা দেন এবং ‘জুলাই মিনার’-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। 

কুমিল্লার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থান শুধু একটি সরকারের পতন নয়, এটি ছিল নতুন প্রজন্মের প্রতিবাদের ভাষা। এই আন্দোলন প্রমাণ করেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগঠিত হলে নিরস্ত্র জনতার শক্তির কাছে কোনো স্বৈরাচার টিকতে পারে না। শহীদদের আত্মত্যাগ কুমিল্লার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

বৈষম্যহীন ও ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য তাঁদের রক্তে লেখা এই সংগ্রাম প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রেরণা হয়ে থাকবে। ‘কুমিল্লা গণঅভ্যুত্থান’ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনার এক অবিস্মরণীয় মাইলফলক হয়ে থাকবে।