শিরোনাম
চাঁদপুর, ৫ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : ২০২৪ এর ৫ আগস্ট ভোর থেকেই চাঁদপুরের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনায় আগুন দেয় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। এই ধারাবাহিকতা চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। ওইদিন সকাল থেকেই শহরের বিভিন্ন স্থান দখলে নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা। আগের দিনের সংঘর্ষের ঘটনায় আত্মগোপনে চলে যায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ। শেখ হাসিনার পতনের সংবাদ পেয়ে জেলা জুড়ে চলে উল্লাস। পৃথক ঘটনায় ৪ উপজেলায় নিহত হয় ৫ জন।
বেলা ১১টার দিকে শহরের বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ফয়সাল শপিং কমপ্লেক্সের সামনে জড়ো হয় শিক্ষার্থীরা। এরপর পর্যায়ক্রমে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ে। বেলা সাড়ে ১১টায় বাবুরহাট এলাকায় চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক সড়ক বন্ধ করে জেলা পরিষদের গেটে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেখানে বেলা ১২টা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা অবস্থান করে। পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর টিআরসেল নিক্ষেপ করে পিছু হটে এবং ১২টার মধ্যে নিরাপদে পুলিশ লাইনে ঢুকে পড়ে।
দুপুর প্রায় ১টার দিকে জাতির উদ্দেশ্যে সেনা প্রধানের বক্তব্য দেয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে চাঁদপুরে অবস্থানরত সেনাবাহিনী জেলা প্রশাসককে তার বাংলো থেকে নিরাপদে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তখন থেকেই সাধারণ মানুষের মধ্যে শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছে বলে আলোচনা শুরু হয়। বিকাল ৩টার দিকে ইন্টারনেট সংযোগ চালু হলে শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার সংবাদ পায় ছাত্র-জনতা।
এ খবর প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথে চাঁদপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাত্র-জনতা শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সমবেত হয়ে বিজয় উল্লাস করে। সন্ধ্যার আগে মিছিল নিয়ে ছাত্র-জনতা শহরের সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করে। এ সময় অনেককেই মিষ্টি বিতরণ করতে দেখা যায়। ওই সময় আওয়ামী পন্থীদের বাসাবাড়ী, অফিস ও অন্যান্য স্থাপনা ভাঙচুর ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়।
এছাড়াও শাহ মাহমুদপুর, আশিকাটি ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে ভাঙচুর, আগুন ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এর আগে রোববার দিবাগত রাতে ১১টা থেকে পরদিন (৫ আগস্ট) সকাল ৯টা পর্যন্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ভাঙচুর ও আগুন দিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। ৫ তারিখ সকালে সরেজমিনে এসব সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভাঙচুর ও আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ভবনগুলোর ধ্বংসযজ্ঞ দেখা যায়।
আন্দোলনকারীরা শহরের প্রবেশ মুখ বাবুরহাট বঙ্গবন্ধু গেট, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনের গেট ও সাইনবোর্ড ভাঙচুর, সড়ক ভবন, রেস্টহাউস এবং ৭টি গাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। এছাড়া স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক ভবন, জেলা ক্রীড়া সংস্থার অফিস ও হলরুম ভাঙচুর করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। তারা পর্যায়ক্রমে ভাঙচুর চালিয়ে জেলা শিশু কর্মকর্তা কার্যালয়ের সাইনবোর্ড, বিটিসিএল জেলা অফিস, জেলা জজ এর বাসভবনের সামনের গেট, জেলা জজ আদালতের নিচতলায় স্থাপিত বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার বিভিন্ন স্থাপনা, মুক্তিযোদ্ধা সড়কে সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর কার্যালয়ের বাহির ও ভেতরে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়।
এছাড়াও আন্দোলনকারীরা সাংবাদিকের কার্যালয়, আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়িতে আগুন ও সড়কের বহু স্থানে আগুন লাগিয়ে দিয়ে। এদিকে চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদ এর আলোচিত চেয়ারম্যান এবং বালু খেকো সেলিম খান ও তার ছেলে নায়ক শান্ত খান গণপিটুনিতে নিহত হন।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ার পরে নিজ এলাকা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বালিয়া ইউনিয়নের ফরক্কাবাদ বাজারে এসে জনরোষে পড়েন সেলিম খান। সেখানে নিজের পিস্তল থেকে গুলি করে উদ্ধার হয়ে আসতে পারলেও পার্শ্ববর্তী বাগাড়া বাজারে এসে জনতার মুখোমুখি হন। সেখানেই জনতার পিটুনিতে নিহত হন সেলিম খান ও তার ছেলে শান্ত খান।
এদিকে শেখ হাসিনার পতনের খবর পাওয়ার পর থেকেই চাঁদপুরের ৮ উপজেলায় উল্লাসে ফেটে পড়ে সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা। সন্ধ্যায় কচুয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মামুনুর রসিদ গণপিটুনিতে ও ফরিদগঞ্জে বিক্ষুব্ধরা থানায় হামলার চেষ্টা কালে পুলিশের গুলিতে শাহাদাত (২০) নামে এক যুবক নিহত হন।
ফরিদগঞ্জে ওইদিন বিকালে একটি বিক্ষোভ মিছিল থানায় প্রবেশের চেষ্টাকালে গেট ভেঙ্গে ফেললে পুলিশ গুলি চালায়। ওই সময় শাহাদাত (২০) ও এমরান হোসেন(৩৮) নামে দুইজন গুলিবিদ্ধ হয়। এতে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আহতদের দ্রুত ফরিদগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক দ্রুত চাঁদপুরে রেফার করলে পথেই শাহাদাতের মৃত্যু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, কচুয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মামুনুর রসিদ উল্লাসের সময় বের হলে তাকে কচুয়া বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজের সামনে পিটিয়ে হত্যা করে বিক্ষুব্ধ জনতা। পরে তার মরদেহ উদ্ধার করে থানায় নেয়া হয়।
এছাড়াও ৫ আগস্ট রাত আনুমানিক ১১টার দিকে শাহরাস্তি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সূচিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান মো. মোস্তফা কামাল মজুমদারের বাড়িতে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। পরে বাড়ির সামনের একটি জলাশয় থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
চাঁদপুর সদর, ফরিদগঞ্জ, কচুয়া ও শাহরাস্তি থানা কার্যালয়ের বিভিন্ন নথি থেকে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।
৫ আগস্ট সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে আহত গণমাধ্যম কর্মীরা জানান, ৫ আগস্ট চাঁদপুরে পুলিশ বাহিনী সকালে শক্ত অবস্থানে থাকলেও দুপুরে নিরাপদে চলে যায়। বিকেলে আনন্দ মিছিল যোগ দেয় সেনাবাহিনী। জেলার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ায় শহরজুড়ে এক শ্রেণির উচ্ছৃঙ্খল যুবক ও কিশোর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও লুটপাট করে।