শিরোনাম
শুয়াইবুল ইসলাম
সিলেট, ৪ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : চব্বিশের জুলাই তখনও চলমান। ছাত্রজনতার ৩৫ জুলাই। অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিন। দ্রোহের আগুনে উত্তাল সারাদেশ। সে আন্দোলন সিলেটের গ্রামীণ জনপদেও ছড়িয়ে পড়ে।
সেদিন ছিল রোববার। সিলেট শহরে চলছে সংঘর্ষ। সরকারদলীয় ক্যাডারদের সশস্ত্র মহড়া, হামলা-পাল্টা প্রতিরোধ। তখন শহর ছাপিয়ে উত্তাপ পৌঁছে যায় গ্রামগঞ্জে। দুপুর থেকে সিলেটের গোলাপগঞ্জে হামলা শুরু হয়। পাল্টা প্রতিরোধে যোগ দেয় কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, আইনজীবী, রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীসহ সর্বস্তরের মানুষ।
এমন সময় সরাসরি গুলি করে ছয় জনকে হত্যা করা হয়। যাদের বেশিরভাগই খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন আন্দোলন ও হতাহতের ঘটনা দেখেনি সিলেটবাসী।
আন্দোলনকারী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে রোববার (৪ আগস্ট) সিলেট নগরের কোর্ট পয়েন্টসহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেন ছাত্ররা। তাদের সঙ্গে যোগ দেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। বিএনপি, জামায়াত, বাসদ, জমিয়ত, খেলাফতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও সেদিন অংশ নেন। পেশাজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, ব্যবসায়ী, কৃষক-শ্রমিক জনতা সেদিন যোগ দেন আন্দোলনে। কোর্ট পয়েন্টে অবস্থানরত ছাত্র-জনতার ওপর দুপুর ১২টার দিকে হামলা করে পুলিশ। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। শুরু হয় পাল্টা প্রতিরোধ। জিন্দাবাজার এলাকায় আন্দোলনরত এক শিশুকে কাছে থেকে গুলি করে পুলিশ সদস্যরা।
এরপর চারদিকে পাল্টা প্রতিরোধ শুরু হয়। জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার, মহাজনপট্টি, জেলরোড, সোবহানীঘাট, নাইওরপুল, মিরাবাজার, চৌহাট্টা, নয়াসড়ক, দরগাহ গেট, আম্বরখানা, মদিনা মার্কেট, দক্ষিণ সুরমার তেতলিসহ শহর ও শহরের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন ছড়িয়ে যায়।
সেদিন বেলা একটার দিকে পুলিশের হামলার সঙ্গে যুক্ত হয় আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলা। চারদিক থেকে দেশীয় অস্ত্র রামদা, হকিস্টিক, পিস্তল, চাইনিজ রাইফেল নিয়ে ছাত্রজনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। ছাত্রজনতা খালি হাতে তাদের প্রতিহত করেছিল। চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত সংঘর্ষ।
৪ আগস্ট দুপুরে জিন্দাবাজার এলাকায় এক আন্দোলনকারীকে কুপিয়ে জখম করে ক্যাডাররা। তার নাম ফয়জুল বারী দিনার। সিলেট এমসি কলেজ শিবিরের তৎকালীন সভাপতি তিনি। দিনার সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমরা খালি হাতে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম। জিন্দাবাজার পয়েন্টে আমরা পুলিশের হামলা প্রতিরোধ করেছি। ঠিক তখন ছাত্র-যুবলীগের ক্যাডাররা দা, কিরিচ, রামদাসহ আমাদের হামলা করে। আমাকে এবং আমার বেশ কয়েক জন সহযোদ্ধাকে কুপিয়ে জখম করে। আমি সেদিন আল্লাহর রহমতে বেঁচে গিয়েছিলাম।’
সেদিন সকাল থেকে কোর্ট পয়েন্টে অবস্থান নেয় বিএনপি ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সেদিনের ভয়াবহতার বর্ণনা দিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দল সিলেট জেলার আহ্বায়ক মাহবুবুল হক চৌধুরী জানান, আন্দোলন এক পর্যায়ে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের নেতাকর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। পুলিশ এপিসি গাড়ি ব্যবহার করেছে। অসংখ্য ছোট ছোট বাচ্চা সেদিন গুরুতর আহত হয়। সন্ধ্যায় সিলেট নগরের কুমারপাড়া এলাকায় মসজিদ থেকে বের হওয়া মানুষের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায় আওয়ামী ক্যাডাররা।
একই সময়ে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায় সৃষ্টি হয় আরেক ইতিহাস। সকাল থেকে গোলাপগঞ্জ শহরে সিলেট-জকিগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করছিলেন সাধারণ ছাত্র-জনতা। ঢাকা দক্ষিণ বাজারে বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ গেট থেকে শিক্ষার্থীরা মিছিল শুরু করলে পুলিশ-বিজিবি ও ছাত্রলীগ-যুবলীগ ক্যাডাররা হামলা করে। সেখান থেকে শুরু হয় পাল্টা প্রতিরোধ। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চলে। সেদিন গোলাপগঞ্জবাসীর পাল্টা প্রতিরোধ ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের ইতিহাসে অমর স্থান দখল করে নেয় এই উপজেলা।
গোলাপগঞ্জে এইদিনে শহীদ হন ছয় জন। তারা হলেন, শহীদ তাজ উদ্দিন, শহীদ নাজমুল ইসলাম, শহীদ হাসান আহমদ জয়, শহীদ সানি আহমদ, শহীদ গউছ উদ্দিন ও শহীদ মিনহাজ উদ্দিন।
ঢাকা দক্ষিণ বাজারের মিছিলে নেতৃত্বে ছিলেন মো. তানজিম আহাদ। তিনি উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। তানজিম আন্দোলন শুরুর বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘আগের দিন (৩ আগস্ট) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষিত গণমিছিল কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বাধার মুখে পড়ি। দল থেকে দিকনির্দেশনা আগেই দেওয়া হয়েছে। অসহযোগ ঘোষণার পর আমরা দলমত নির্বিশেষে একাত্ম হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মিছিল শুরু হলে স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা প্রথমে বাধা দেয়। আমরা ধাওয়া দিলে তারা পালিয়ে যায়। এমন সময় সকাল সাড়ে ১১টার দিকে তৎকালীন এসিল্যান্ডের নেতৃত্বে বিজিবি ও পুলিশের একাধিক গাড়ি সেখানে হাজির হলে শুরু হয় সংঘর্ষ।’
এসময় ছাত্রদের আরো কয়েকটি গ্রুপ মিছিল নিয়ে যোগ দেয়। শুরু হয় প্রতিরোধ। বিজিবি ও পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। পাল্টা প্রতিরোধে তারা পিছু হটতে শুরু করে।
প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক রিমন আহমদ জানান, পুলিশ ও বিজিবি ফাঁকা গুলি, টিয়ারশেল ছুঁড়তে ছুঁড়তে গোলাপগঞ্জ শহরের দিকে পিছু হটছিল। অনেক ব্যবসায়ী, গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ এই আন্দোলনে যোগ দেয়। বারকোট নামক স্থানে দুইদিক থেকে পুলিশ-বিজিবিকে ঘেরাও করে মানুষ। তখন সরাসরি গুলিতে চার জন নিহত হন।
বেলা পৌনে দুইটায় নিজ বাড়ির সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান শহীদ তাজ উদ্দিন। তার বোন ফাতিমা বেগম বলেন, সেদিন অনেকেই আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। হঠাৎ পুলিশের গুলির শব্দ শুনতে পাই। এমন সময় খবর পাই বড় ভাই তাজ উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি মারা যান।
আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন মোহাম্মদ অলি আহমদ। তিনি বর্তমানে জুলাই মঞ্চ সিলেট জেলার ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষা প্রতিনিধি। অলি জানান, সেদিন গোলাপগঞ্জের বেশিরভাগ মানুষ আমাদের আন্দোলনে যোগ দেন। পরিবহণ শ্রমিকরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। অনেকে খাবার ও পানি নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। সারাদিন আন্দোলন করেছি। আহতদের হাসপাতালে নেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। ধারাবহর ও গোলাপগঞ্জ পৌর শহরে গুলিবিদ্ধ বেশ কয়েকজন মানুষকে নিজে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছি। যার যে প্রশিক্ষণ আছে তা কাজে লাগিয়েছেন।
বেলা তিনটার দিকে গোলাপগঞ্জ শহরের এমসি একাডেমির দিক থেকে ছাত্র-জনতার আরেকটি গ্রুপ আন্দোলনে যোগ দেয়। পুলিশ ও সরকার দলের ক্যাডারদের গুলির পাল্টা জবাবে ছাত্রজনতা দুই দিক থেকে ইটপাটকেল ছুঁড়ে প্রতিরোধ করে। ঘেরাও করা হয় গোলাপগঞ্জ থানা। বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে গোলাপগঞ্জ থানার ছাদ থেকে গুলি ছোঁড়া হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান মিনহাজ ও গৌছ।
মিনহাজের ভাই সাঈদ আলম বলেন, ছাত্র-জনতার ওপর যখন আক্রমণ করা হয় তখন আমরা ব্যবসায়ীরা দোকানপাঠ রেখে তাদের পক্ষে দাঁড়াই। আমি ও আমার ভাই হতাহত অনেককে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠাচ্ছিলাম। এমন সময় আমার ভাই মিনহাজ গুলিবিদ্ধ হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যু হয়।