শিরোনাম
আব্বাছ হোসেন
লক্ষ্মীপুর, ৪ আগস্ট ২০২৫ (বাসস): ৪ আগস্ট ২০২৪। রোববার। সকাল সাড়ে ৭টা। শহরের অলিগলি থেকে বাগবাড়ি কৃষি অফিসের সামনে আন্দোলনকারীরা জড়ো হতে চেষ্টা করে। এসময় কলেজ ছাত্রলীগ নেতা মাহমুদ, জুয়েল, যুবলীগের ইমন ও রায়হানসহ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ২০ থেকে ৩০জন অস্ত্রধারী নেতাকর্মী আন্দোলনরত কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ধরে ব্যাপক মারধর করে। এ ঘটনায় অন্দোলনকারীরা পিছু না হটে মোকাবেলার চেষ্টা করে। হামলার খবর ছড়িয়ে পড়লে ছাত্র-জনতা বাগবাড়িতে একত্রিত হয়ে মিছিল বের করে। পরে আন্দোলনকারীরা ঝুমুর এলাকায় অবস্থান নেয়।
একই সময় উত্তর তেমুহনীতে জড়ো হতে থাকে আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সদর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি কবির পাটওয়ারী, সাইফুল হাসান পলাশ, পৌর আওয়ামীলীগের সভাপতি সৈয়দ আহমদ পাটওয়ারী ও অ্যাডভোকেট জহির উদ্দিন বাবর, জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি একেএম সালাউদ্দিন টিপু, যুবলীগ নেতা বায়োজিদ ভূইয়া, শাখায়াত হোসেন আরিফ, ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুল ইসলাম রকি ও সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন ভূইয়া, নজরুল ইসলাম ভুলু, সাবেক পিপি জসিম, রাসেল মাহুমদ মান্না, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বাবর ও রাকিব হোসেন লোটাস, শাহজাহান মেম্বার, দিঘলীর জাবেদ, তাজু, মেম্বার সোহেল, চন্দ্রগঞ্জের ছাত্রলীগ নেতা মাসুদ, আবু তালেব, বাংগাখাঁর মিজানুর রহমান ভুঁইয়ার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা উত্তর তেমুহনীতে জড়ো হয়। এছাড়া সাবেক পৌর মেয়র মোজাম্মেল হায়দার মাসুম ভুঁইয়ার নেতৃত্বে হ্যাপী সড়ক থেকে একটি মিছিল নিয়ে বের হয়। প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে কথা বলে এবং আন্দোলনের ভিডিও ফুটেজ থেকে এসব তথ্য জানা যায়
সকাল সাড়ে ১০টা। হঠাৎ লাঠি সোঁটা ও অস্ত্রসহযোগে উত্তর তেমুহনী থেকে মিছিল নিয়ে ঝুমুরের দিকে অগ্রসর হয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। মিছিলটি বাগবাড়িতে পৌঁছালে আওয়ামী লীগের হামলায় কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়। এসময় বেশ কয়েকটি ককটেল ফাটিয়ে এলাকায় চরম আতঙ্ক ও ত্রাস সৃষ্টি করে মিছিলকারীরা। হামলার খবর পেয়ে ঝুমুর এলাকা থেকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বাগবাড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। মিছিলটি মাদাম ব্রিজের পূর্বপ্রান্তে পৌঁছলে টিপু, বায়োজিদ ভূইয়া ও হেলমেট পরা কয়েকজন সন্ত্রাসী শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। এসময় কয়েকজন সাংবাদিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গুলির মুখোমুখি হয়ে দায়িত্ব পালন করে। এক পর্যায়ে সার্কিট হাউজ গেটের সামনে অবস্থান নেয় সাংবাদিকরা। সার্কিট হাউজের গেট তালাবদ্ধ থাকায় এক বিভীষিকাময় সময় পার করেন তারা। এসময় ব্রিজের ওপর প্রথম গুলিবিদ্ধ হয়ে কলেজ শিক্ষার্থী সাদ আল আফনান ঘটনাস্থলে নিহত হন। আহত হয় অর্ধশতাধিক।
আফনান নিহতের খবর ছড়িয়ে পড়লে হাজারো ছাত্র-জনতা জড়ো হয়ে আওয়ামী বাহিনীকে ধাওয়া করে। এইভাবে চলতে থাকে একের পর এক ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। আর পিছু হটতে থাকে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে রাস্তা ছেড়ে টিপু ও তার লোকজন তমিজ মার্কেট, তার বাসা ও ছাদে অবস্থান নেয়। শিক্ষার্থীরা উত্তর তেমুহানী ও দক্ষিণ দিক থেকে দুভাগে বিভক্ত হয়ে টিপুর বাসার দিকে অগ্রসর হয়।
এসময় টিপু ও তার লোকজন বাসার ছাঁদ থেকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ঁতে থাকে শিক্ষার্থীদের ওপর। টিপুর আরেকটি গ্রুপ নিচে শাঁখারি পাড়া মোড় ও তিতা খাঁ মসজিদ এলাকায় আন্দোলনকারীদের উপর কয়েক দফা হামলা করে। এখানে দীর্ঘক্ষণ চলে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও ককেটল বিস্ফোরণ। টিপুর গুলিতে আরো তিন আন্দোলনকারী নিহত হন। তারা হলেন, সাবির হোসেন, কাউছার হোসেন বিজয় ও ওসমান গনি। এ নিয়ে ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চার শিক্ষার্থী নিহত হন। আড়াইশ গুলিবিদ্ধসহ আহত হয় তিনশর বেশি মানুষ। এতে টিপুর বাসভবনে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে আন্দোলনকারীরা। এদিন বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে গণটিপুনিতে টিপুর ৮ কর্মী নিহত হয়। অবরুদ্ধ অবস্থায় আটকা পড়ে টিপুর বাসার ভিতরে ২৮জন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গভীর রাতে তাদের উদ্ধার করে নিরাপদে পৌঁছে দেয় ।
চার শিক্ষার্থী হত্যা মামলা
লক্ষ্মীপুর জেলা সদর থানা সূত্রে জানা যায়, সাদ আল আফনান হত্যার ঘটনায় নাছিমা আক্তার বাদী হয়ে, টিপু ও মাসুম ভূইয়াসহ ৭৫জনের নাম উল্লেখ করে আরো ৬০০জনকে অজ্ঞাত আসামি করে সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় গ্রেফতার করা হয় ৪৬জনকে। এর মধ্যে ৩০জনকে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। ঘটনার সাথে জড়িত থাকার ভিডিও চিত্রে আরো ১০০জনকে চিহ্নিত করা হয়। অপরদিকে সাব্ব্রি হোসেন হত্যার ঘটনায় পৃথক আরো একটি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় ৯১ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত ২০০ জনকে আসামি করা হয়। গ্রেফতার করা হয় ৮৩ জনকে। ৭৫ জনকে রিমান্ডে নেয়া হয়। শনাক্ত করা হয় আরো ১০২ জনকে।
গুলিবিদ্ধ আহত আবদুল মতিন আরো একটি মামলা করেন। ওই মামলায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক এমপি গোলাম ফারুক পিংকুসহ ৭৬জনের নাম উল্লেখ করে আরো দেড়শ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। এই মামলায় ২২জন গ্রেফতার হয়। এছাড়া গুলিবিদ্ধ আল সবুজ আরো একটি মামলা করেন। সবুজের মামলায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়নসহ ১৬২জন ও অজ্ঞাত ৩০০জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। এ মামলায় ৪৭জনকে গ্রেফতার করা হয়। অপর পুলিশের পক্ষ থেকেও আরো একটি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডসহ বিভিন্ন ইউনিটের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ ১৮৬জনকে গ্রেফতার করা হয়।
নিহত সাদ আল আফনানের মা নাছিমা আক্তার বলেন, ছেলে হারিয়েছি। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন চাপে নিজের ঘরে ঘুমাতে পারছি না। হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই। বিচার চাই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের জেলা আহ্বায়ক মো. আরমান হোসাইন বলেন, হাসিনার পতনের একদফা দাবিতে যখন আন্দোলন চলছে। ৪ আগস্টে ছাত্র-জনতার উপর টিপুসহ আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের নির্দেশে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে চারজনকে হত্যা করা হয়। এদিন আহত হয় প্রায় ৪শতাধিক ছাত্র-জনতা। এসব ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সদর থানার এস আই মোবারক হোসেন ও ফজলুল করিম বলেন, ইতিমধ্যে চার আগস্টের দায়ের করা মামলায় ২০০জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১২০জনকে রিমান্ডে আনা হয়। পাশাপাশি ঘটনার সাথে প্রকাশ্যে জড়িত থাকার ভিডিও চিত্রে আরো ১১৩জনকে শনাক্ত করা হয়। এছাড়া ঘটনাস্থল থেকে জব্দকৃত আলামত ফরেনসিক রিপোর্টে সত্যতা মিলেছে। আসামিদের গ্রেফতারের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আবদুল মোন্নাফ বলেন, ছাত্র-জনতার উপর হামলাকারীরা কেউ ছাড় পাবেনা। সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। প্রতিদিনই অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
পুলিশ সুপার মো. আকতার হোসেন বলেন, জুলাই আন্দোলনে চার শিক্ষার্থী হত্যা মামলায় পুলিশ আন্তরিকতার সাথে কাজ করছে। ইতিমধ্যে ২০০জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব মামলার প্রতিবেদন দেয়া হবে বলে জানান তিনি।